দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা [Dekhite Giyachhi Porbotmala]
By Mahbub Azad
5/5
()
About this ebook
২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বান্দরবান থেকে দক্ষিণ রাঙামাটিতে রাইনক্ষ্যং নদীর উৎসমুখে ট্রেকিঙে গিয়েছিলেন কয়েকজন অভিযাত্রী। সে যাত্রার বিবরণের সঙ্গে বাগাড়ম্বরের যোগফল এই গ্রন্থটি।
Related categories
Reviews for দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা [Dekhite Giyachhi Porbotmala]
1 rating0 reviews
Book preview
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা [Dekhite Giyachhi Porbotmala] - Mahbub Azad
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
মাহবুব আজাদ
শিরোনাম দেখে পাঠকসমাজের (পাঠিকারাও আছেন এই দলে) মনে হতে পারে, হিমালয় বা আনদেজ চষে বেড়িয়ে এসে কলম হাতে নিয়েছি। আদপে ব্যাপারটা সেরকম নয়, ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেলে, বান্দরবানের রুমা থেকে রাঙামাটির পুকুরপাড়া পর্যন্ত বিসতৃত গরীবের এই অভিযান।
ভেবেছিলাম উত্তম পুরুষে লিখবো না, তেমনটা লেখা এই নরাধমকে মানায়ও না। কিন্তু এবারের যাত্রায় অনেকেই পৃথক ফল হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, কাজেই সেসব ফলের একটা সালাদ পাঠকের সামনে হাজির না করে বরং পেছন ফিরে আমার চোখেই গোটা অভিযানটাকে আগাপাশতলা একবার চেখে দেখি। স্মৃতির সাগর মন্থন করতে থাকলে এক সময় অমৃত কিছু মিলবেই, আর গরল যা উঠে আসবে, তা নিজের গলায় রেখে নীলকন্ঠ সাজতে আমার কিচ্ছু আপত্তি নেই।
এক: নির্গলদ বিসমিল্লাহ
কেওকারাডং, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (মাত্র ৩,১৭২ ফিট উঁচু), আর সেখানেই নানা রূদ্ধশ্বাস কাহিনীর বুনটে সূর্যোৎসবের অভিযান দিয়েই EXPLORERS' CLUB OF BANGLADESH-এর যাত্রা শুরু। বলা যেতে পারে, বান্দরবানের গহীন পাহাড়ি এলাকাই এই ক্লাবের আঁতুড়ঘর। ক্লাবের অভিযাত্রীদের অনেকেই পরে আবারো ফিরে গেছেন কেওকারাডঙে, বিভিন্ন দলে, বিভিন্ন ঋতুতে, বিভিন্ন পথে। জীবনানন্দ দাশের ক্যাম্পে কবিতার বিখ্যাত-বিতর্কিত একটি পঙক্তি পড়েছিলাম:
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে
--- যদি বলি এক্সপ্লোরার ক্লাবের সদস্যদের কাছে নোনা মেয়েমানুষটি হচ্ছে বান্দরবানের পাহাড়গুচ্ছ, খুব একটা অতিশয়োক্তি হবে না। এই পাহাড়ের সারিগুলোর সৌন্দর্যের সাথে লুকিয়ে আছে এক আকর্ষক শক্তি, যা একজন ট্রেকারকে একাধিক অভিযানের জন্যে হাতছানি দেয়। এই ফেব্রুয়ারিতে সেই হাতছানিকে উপেক্ষা করার শক্তি ECB সদস্যদের একদমই ফুরিয়ে এসেছিলো।
পাহাড় কতখানিই বা আছে এই বাংলাদেশে? উত্তরে গারো পাহাড়ের কয়েকটি শিরা, উত্তর পূবে খাসিয়া আর জয়ন্তিয়া পাহাড়ের খাটো দেয়াল, আর নিচে দক্ষিণ পূবে মগের মুল্লুকে আরাকানের কিছু দলছুট পাহাড়। বাংলাদেশের ভেতরে এক হাজার মিটারের ওপরে কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এই স্বল্প উচ্চতার --- স্বল্প বলছি এ কারণে, একবার উত্তর পশ্চিমে চোখ মেলে তাকালেই নগরাজ হিমালয়কে চোখে পড়ে --- মাঝেই পাহাড়গুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রস্তরনন্দিনী সব ঝর্ণা, পাথুরে ছড়ার খাত, ঘন নিবিড় জঙ্গল, হঠাৎ গভীর খাদ, বাঁশের ঝোপে ছাওয়া উপত্যকা আর জুম্ম চাষের ঢালু ক্ষেত। এর ফাঁকে ফাঁকেই হয়তো চোখে পড়ে আচমকা জেগে ওঠা দ্বীপের মতো একেকটা পাড়া, অর্থাৎ পাহাড়ীদের গ্রাম। তেমনই একটা গ্রাম, পুকুরপাড়া অভিযাত্রীদের এবারের যাত্রার গন্তব্য। পুকুরপাড়া রাঙামাটি জেলায় পড়লেও, সেখানে যেতে হলে বান্দরবানের রুমা থেকে যাওয়াটাই সঙ্গত। ম্যাপে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেই বুঝবেন, কেন এ কথা বলছি। রাঙামাটির দক্ষিণ তৃতীয়াংশে অবস্থিত এই পাড়া একটা বিশাল পাহাড়ী দীঘিকে ঘিরে, বহুল আলোচিত বগালেকের চেয়ে আয়তনে কয়েকগুণ বড় এই দীঘির কাছেই রয়েছে রাইনক্ষ্যং নদীর একটি প্রপাত, এঁকেবেঁকে যে নদীটি যাত্রায় ক্ষান্তি দিয়েছে কাপ্তাই হ্রদের বুকে মুখ গুঁজে। আর এই রাইনক্ষ্যং-জলপ্রপাতই হয়ে উঠেছে ECB সদস্যদের পিপাসু চোখের লক্ষ্যবস্তু।
ECB সম্পর্কে যারা একটু আধটু জানেন, তাঁরা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, এই ক্লাবের সদস্যেরা, যাদের বয়স আট থেকে আটাশির মধ্যে, যাবতীয় সরকারি ছুটির চরম সদব্যবহার --- অথবা বদব্যবহার --- করে থাকেন, বিশেষ করে দুই ঈদের প্রশস্ত ছুটিগুলো তাঁরা কাটিয়ে দেন কোন এক পথে কাঁধে হ্যাভারস্যাক ঝুলিয়ে কোন সুদূর গন্তব্যের দিকে জোর পায়ে হাঁটায়। তাই ফেব্রুয়ারির দুই তারিখে, কোরবানি ঈদের লঘু ছুটিতেই যাত্রা শুরু করার গুরু সিদ্ধান্ত নেয়া হলো (কোরবানি ঈদের ছুটি যেমন খানিকটা প্রশস্ত, তেমনই আরেকটা সুবিধে হচ্ছে, এ সময়ে আকাশে শুক্লপক্ষের কড়া চাঁদ থাকে, রাতে পথ চলতে সুবিধে হয়)। বিকেলের মধ্যে কোরবানির দায়দায়িত্ব সেরে, নিহত পশুর ঝোল দিয়ে মেখে ভরপেট সেদ্ধ ধানের-দানা দিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে, ধীরেসুস্থে একেকজন হাজির হবেন কমলাপুরে বাস স্টেশনে, তেমনই অলিখিত চুক্তি হলো সবার মধ্যে।
এবারের দল তুলনামূলকভাবে ছোট, কারণ কোরবানি ঈদে যাঁরা ঢাকার বাইরে বেরিয়ে পড়বেন, অথবা ঢাকায় ঈদোত্তর মেহমানদারিতে লিপ্ত হয়ে পড়বেন, তাঁরা গা মুচড়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। ব্যতিক্রম শামীম খান মিলন, ক্লাবের দুর্দান্ত প্রতিশ্রুতিশীল সদস্য, যিনি আগে কখনো বান্দরবান যাননি। সুদূর সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তিনি প্রথমে পৌঁছুবেন সাতক্ষীরা, সেখান থেকে ঢাকার বাসে চড়ে পৌঁছুবেন ঢাকায়, তারপর আবার বাসে চড়ে বসবেন, বান্দরবানের পাহাড়গুলোকে এক হাত দেখে নেয়ার জন্যে, কম হ্যাপা নয়। আর আছে চঞ্চল, যে তার নামের যথার্থ সম্মান করতে শিখেছে, এই প্রথম পাহাড়ে চড়তে বেরিয়ে উৎসাহের চোটে একদিন আগেই কঙ্বাজার গিয়ে বসে আছে ব্যাটা, তিন তারিখ সকালে মূল দলের সাথে যোগ দেবে সে। এবার দলনেতা উচ্ছল, ইনিও নামের সাথে ঘাড়ত্যাড়ামো করেননি। ক্লাবের পথপ্রদর্শক বরুণ বকশী আর শাহেদ কামাল তো সাথে আছেনই, আর পাহাড়ের পথ প্রদর্শক মংক্ষিয়া মারমা আমাদের সাথে যোগ দেবেন বান্দরবান থেকে। ঘাগু দুই হাঁটাবাজ সালেহীন আর সৈকত মোটেও পিছপা নয়, যেমনটা নন পুতুল আপা, যেমনটা নই --- ইয়ে, আমি।
দশ চক্রে ভগবান ভূত হয়, আর পুকুরপাড়া তো কোন ছার। দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ, এমনই চিন্তা পুষে রাখা বুকটাকে ঠুকে নিয়ে ঈদের আগের দিন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি। আমার হাবাগোবা গোছের হ্যাভারস্যাক আগেও অনেক ধকল সয়েছে --- সাঙ্গু নদীতে গতবছর তার আরেকটু হলেই সলিল সমাধি ঘটতো, ওয়াহিদ ভাই সময় মতো কান ধরে টেনে না তুললে --- তাই এবার বেচারাকে একটু নিষকৃতি দেয়ার বাসনায় কেবল একটি প্যান্ট, একটি গেঞ্জি আর কী একটি যেন ঢোকাই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তাতে ঢোকে একখানা ট্রাইপড, একটা ক্যামেরা, একটা বাইনোকুলার, গামছা, টয়লেট পেপার, শুকনো খাবার, ইত্যাদি ইত্যাদি। কোরবানির মাংস ওজন করার যন্ত্রটায় চাপিয়ে দেখা গেলো, বারো কেজির চেয়ে একটু বেশি ওজন হয়েছে ব্যাগটার। এর আগে কেওকারাডং যাত্রায় আমার বোঁচকার ওজন হয়েছিলো সতেরো কেজি, এবার তারচেয়ে ঝাড়া পাঁচ কেজি কম।
ঈদসংক্রান্ত সামাজিকতা সেরে রাত সাড়ে দশটার মধ্যে কমলাপুরে পৌঁছে সেখানে প্রায় সবাইকে পেয়ে গেলাম। আরো কয়েকটা ছোট ছোট গ্রুপ চলেছে বান্দরবানে, তাঁরাও রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে বাস স্টেশনে উপস্থিত। আমাদের তোড়জোড় দেখে এক সহযাত্রী জানতে চাইলেন, আমরা কেওকারাডঙে যাচ্ছি কি না। পুকুরপাড়ার নাম শুনে ভদ্রলোক নাক সিঁটকালেন, অর্থাৎ, তিনি পুকুরপাড়ার নাম ইহজীবনে শোনেননি, এটা আবার কোথায় ---? তাঁরা সবাই চলছেন কেওকারাডঙে, গম্ভীরমুখে জানালেন।
বাস জার্নির বর্ণণা কী আর দেবো? প্রায় ফাঁকা রাস্তায় উল্কা বেগে ছুটছে বাস, হেডলাইটের আলোয় অন্ধকারের একটা সামান্য অংশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ক্ষণিকের জন্য, তারপর আবার ডুবে যাচ্ছে আঁধারে। ঈদক্লান্ত ঢাকা শহরকে পেছনে ফেলে বান্দরবান পৌঁছতে আমাদের চারপাশে ভোর ঘনিয়ে আসে।
কিন্তু বান্দরবানে পৌঁছে সংকটের চেহারাটা চোখে পড়ে সবার। চঞ্চল বান্দরবানেই রাত কাটিয়ে ভোরে মূল দলের সাথে যোগাযোগ করবে, এমনই কথা ছিলো। কিন্তু বাস স্টেশনের আশেপাশে তার চেহারাখানা দেখা যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ অপেক্ষার ফাঁকে হাতমুখ ধুয়ে ফেললেন সকলে, আর পুতুল আপা র্যাকস্যাকটাকে ঠিকমতো বাঁধাছাদা করতে বসলেন। তখন দেখলাম, একগাদা আচারের বোতল নিয়ে এসেছেন তিনি। সবার সাথেই কিছু না কিছু নগণ্য শুকনো খাবার আছে, যেমন আমার ব্যাগের ভেতরে পাঁউরুটি, বরুণদার কাছে চিঁড়া, সে জায়গায় পুতুল আপা জগদ্দল কাঁচের বয়ামে করে আচার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? হুড়োহুড়ি করে সেই বোঝা ভাগাভাগি করে নিলাম