যা না জানলে মুসলিম থাকা যায় না / Ja na janle muslim thaka jaina (Bengali)
5/5
()
About this ebook
আমাদের সমাজ নানাবিধ কুসংস্কারে ভরপুর। কিছু মানুষ কল্যাণের আশায় মাজারের ওসিলায় দু‘আ করতে যাচ্ছে অথচ তারা নিজেকে মুসলিম মনে করেছে। কিছু মানুষ মুহাম্মাদ (সা.) কে সর্বদা সকল স্থানে উপস্থিত হতে পারে এবং সকল গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করছে অথচ নিজেকে মুসলিম মনে করছে। আবার কিছু মানুষ পীরসাহেব মুরিদের সকল কিছু সম্পর্কে খবর রাখে এটা বিশ্বাস করছে অথচ নিজেকে মুসলিম মনে করছে।
আবার সমাজের আরেক শ্রেণীর লোক যারা আল্লাহর উলুহিয়াত, রুবুবিয়তে শিরক করে জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সমরনীতি, বিচার ব্যবস্থাসহ সকল বড় বড় জায়গায় তারা তাগুতের অনুসরণ করছে অথচ নিজেকে (ব্যক্তি জীবনে কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদাত করেই) মুসলিম মনে করছে এবং বুজুর্গও ভাবছে নিজেকে।
এ তো গেল দুই শ্রেণীর কথা কিন্তু আরেক শ্রেণী হলো কুরআন সুন্নাহ দলিলসহকারে অধ্যয়নের পরেও তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে। আর ইকামাতে দ্বীনের অনুসারীদের এ দোষ সে দোষ খুঁজে বেড়ায়। তারা ইসলামের সকল বিধান ব্যক্তি জীবনে দলিলসহকারে মানতে তাগিদ দেয়। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে নাকি ইসলাম কায়েমের ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই, এটা নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে আলাদা দান বিশেষ।
এই গ্রন্থতে প্রথমে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত মানব জীবনে ইসলামের প্রয়োজনীয়তা কী সে সম্পর্কে আংশিক দলিলসহকারে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর মূল বিষয়ের উপরে আলোচনা এবং সবশেষে শিরকের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা ও ভ্রান্তদের কিছু পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে যা জানা অত্যধিক জরুরি। দলিল হিসেবে কুরআনের আয়াত উচ্চারণসহ তুলে ধরা হয়েছে এবং অন্যান্য দলিলে শুধু অর্থ তুলে ধরা হয়েছে।
Related categories
Reviews for যা না জানলে মুসলিম থাকা যায় না / Ja na janle muslim thaka jaina (Bengali)
2 ratings0 reviews
Book preview
যা না জানলে মুসলিম থাকা যায় না / Ja na janle muslim thaka jaina (Bengali) - জাহাঙ্গীর হোসাইন Jahangir Hosain
তোহফা
যারা আল্লাহর রাস্তায় জীবন দেয় তোমরা তাদের মৃত বলো না, বরং তারাই হলো প্রকৃত জীবিত। তোমরা অনুধাবন করতে পারো না।
(সূরা বাকারা : ১৫৪)
তাদের উদ্দেশ্যে, যারা বুকের তাজা খুন ঢেলে দিয়ে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথে মহা মহীরুহে অবিরাম ধারায় পানি সিঞ্চন করে চলছে।
তাদের উদ্দেশ্যে, যারা এ জমিনে দ্বীনে হকের বিজয় কেতন উড়াবার জন্যে, শাহাদাতের অনন্য নজির পেশ করে যাচ্ছে।
তাদের উদ্দেশ্যে, যারা জীবনের সব পিছুটান ফেলে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অনন্ত জীবন পাওয়ার আশায়।
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্যে যিনি আমাদেরকে খেলাফতের মর্যাদা দিয়ে মানবরূপে সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ নবী পাঠিয়েছেন এবং শ্রেষ্ঠ কিতাব মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারীম দিয়েছেন। যার থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আদম সন্তানেরা জ্ঞান আহরণ করতে থাকবে।
দীর্ঘদিন যাবৎ যে বিষয়টি লেখার প্রয়োজন অনুভব করে আসছি, আজ জ্ঞানের স্বল্পতা সত্ত্বেও সে বিষয়ের প্রতি কলম ধরা একান্ত প্রয়োজন মনে করেছি। আমাদের সমাজ নানাবিধ কুসংস্কারে ভরপুর। কিছু মানুষ কল্যাণের আশায় মাজারের ওসিলায় দু‘আ করতে যাচ্ছে অথচ তারা নিজেকে মুসলিম মনে করেছে। কিছু মানুষ মুহাম্মাদ (সা.) কে সর্বদা সকল স্থানে উপস্থিত হতে পারে এবং সকল গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করছে অথচ নিজেকে মুসলিম মনে করছে। আবার কিছু মানুষ পীরসাহেব মুরিদের সকল কিছু সম্পর্কে খবর রাখে এটা বিশ্বাস করছে অথচ নিজেকে মুসলিম মনে করছে। ইহুদীরা ওযায়েরকে আল্লাহর পুত্র আর খৃষ্টানরা মাসীহ (ঈসা) কে আল্লাহর পুত্র বলেছে আর কিছু মুসলিম দাবিদার তাদেরই অনুকরণে মুহাম্মাদ (সা.) কে আল্লাহর জাতি নূর বলে শিরক করছে অথচ নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছে। যে ধরনের ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলা তার জীবিত বড় বড় ফিরিশতা জিব্রাঈল, মিকাঈল (আ.) কে দেন নি, সেই ধরনের ক্ষমতা নাকি মৃত পীরদের দিয়েছেন যেমন, সন্তান দান করা, সাগরের জাহাজ ডুবি থেকে রক্ষা করা, নদী ভাঙ্গা ঠেকানো ইত্যাদি বিশ্বাস করে তবুও নিজেকে মুসলিম মনে করে।
আবার সমাজের আরেক শ্রেণীর লোক যারা আল্লাহর উলুহিয়াত, রুবুবিয়তে শিরক করে জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সমরনীতি, বিচার ব্যবস্থাসহ সকল বড় বড় জায়গায় তারা তাগুতের অনুসরণ করছে অথচ নিজেকে (ব্যক্তি জীবনে কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদাত করেই) মুসলিম মনে করছে এবং বুজুর্গও ভাবছে নিজেকে। ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদসহ সকল মানবরচিত মতবাদ মানছে আদবের সাথে আবার মসজিদে আগের কাতারে থেকে নিজেকে খাঁটি মুসলিম মনে করছে অথচ উক্ত দুই শ্রেণীর লোকদেরই উচিত ছিল গায়েবি সাহায্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে যেমন আল্লাহকে একক বলে মানা, আবার উলুহিয়াত, রুবুবিয়তের ক্ষেত্রে তাগুতকে উৎখাত করে রাজনৈতিক ময়দানে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করা।
এ তো গেল দুই শ্রেণীর কথা কিন্তু আরেক শ্রেণী হলো কুরআন সুন্নাহ দলিলসহকারে অধ্যয়নের পরেও তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে। আর ইকামাতে দ্বীনের অনুসারীদের এ দোষ সে দোষ খুঁজে বেড়ায়। তারা ইসলামের সকল বিধান ব্যক্তি জীবনে দলিলসহকারে মানতে তাগিদ দেয়। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে নাকি ইসলাম কায়েমের ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই, এটা নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে আলাদা দান বিশেষ।
অথচ যদি একটু মনোযোগসহকারে নিরপেক্ষ মন নিয়ে কুরআন অধ্যয়ন করা হয়, বুঝা যায় কুরআনে বর্ণিত ২৫জন নবীর জীবনী থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম শুধু ব্যক্তিজীবনে মানার জন্য আসেনি সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ইসলাম এসেছে।
আর তারা বলে গণতন্ত্র ইসলামের পদ্ধতি নয়, কাজেই এ থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু যে বিষয়টি তাদের মাথায় থাকা উচিত তা হলো যে সমাজে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) আগমন করেছিলেন সেখানে কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না, ছিল গোত্রীয় শাসন ব্যবস্থা। সামগ্রিকভাবে কোনো সুশৃঙ্খল সরকারের শাসনাধীনে দেশ ছিল না। তার পরেও আল্লাহর রাসূল (সা.) কে তাদের সাথে সন্ধি চুক্তি করতে হয়েছিল নিজের রাসূল নাম কেটে দিয়ে।
দীর্ঘদিন কাবাগৃহের মূর্তিগুলো সমেতই সেই ঘরের দিকে সাজদা করতে হয়েছিল। মদীনার ছোট্ট রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইহুদীদের সাথে মদিনা সনদের চুক্তি করতে হয়েছিল। কাজেই নিজের আদর্শের গতিপথ ঠিক রেখে গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করা এই ভূখণ্ডে এখন সময়ের দাবি। আর দ্বীন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সমমনাদের সাথে জোট করাও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ সমস্ত অজুহাত দাঁড় করিয়ে ইকামাতে দ্বীন থেকে দূরে থাকার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা যে বিধানই দিয়েছেন, তার বেশিরভাগই রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, নামায কায়েম করতে আর যাকাত আদায় করতে। রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া নামায কায়েমও সম্ভব নয় যাকাত আদায়ও সম্ভব নয়। তেমনিভাবে সুদ, অশ্লীল সিনেমা, মদ, জুয়া, দুর্নীতিসহ কোনোটাই পরিপূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না অথচ আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে নিষেধ করেছেন। আর ইসলামী বিচারব্যবস্থার অন্যান্য দিক তো আছেই। এজন্য প্রয়োজন হলো রাষ্ট্রের অনুমোদিত বা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় পরিপূর্ণ মিশন নিয়ে দ্বীনে হক প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করে যাওয়া এবং নিজের ব্যক্তি জীবনে মেনে চলা।
এই গ্রন্থতে এই বিষয়গুলোই আমি যথা সম্ভব দলিলসহকারে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি, যার নামকরণ করা হয়েছে "যা না জানলে মুসলিম থাকা যায় না। প্রথমে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত মানব জীবনে ইসলামের প্রয়োজনীয়তা কী সে সম্পর্কে আংশিক দলিলসহকারে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর মূল বিষয়ের উপরে আলোচনা এবং সবশেষে শিরকের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা ও ভ্রান্তদের কিছু পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে যা জানা অত্যধিক জরুরি। দলিল হিসেবে কুরআনের আয়াত উচ্চারণসহ তুলে ধরা হয়েছে এবং অন্যান্য দলিলে শুধু অর্থ তুলে ধরা হয়েছে।
সুদীর্ঘ ১২ বছরের মত সময় ঢাকায় অবস্থান করছি। দীর্ঘ ৩ বছর যাবৎ গুলশানে পলমল গ্র"পের একটি অফিসে চাকুরিতে থেকে যে সময়টুকু পেয়েছি তা ব্যয় করেছি কুরআন সুন্নাহ গবেষণার কাজে। ইতোপূর্বে ২০০০ সাল থেকে ২০০৩ সালের শেষ পর্যন্ত ৪ বছরে বিভিন্ন বিদয়াতী বইসমূহ ইসলামের নামে অধ্যয়ন করেছি। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে সরাসরি কুরআন এবং তাফসীর অধ্যয়ন শুরু করেছি। তারপর বুঝতে পেরেছি, আগে যা পড়েছি তার ভেতরে কত ভুল ছিল।
যা হোক দীর্ঘ সময় ঢাকায় অবস্থান করার পরে আল্লাহ যা সফলতা দিয়েছেন তা হলো ছোট ভাই মিজানকে নিজ খরচে লেখাপড়া করিয়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আরেক ছোট ভাই হাফিজকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ করে দিতে পেরেছি। আমার এই লেখার কাজে ছোট ভাই হাফিজ আমাকে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে এবং বাড্ডা আলাতুন্নেছা হাইস্কুলের শিক্ষক আবু তালহা ভাইও আমাকে যথেষ্ট তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন-এজন্য তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমরা তিন ভাই, পিতা-মাতা এবং বড় বোনসহ সকল পাঠকের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সহায় কাম্য। সকল পাঠক-পাঠিকার প্রতি আমার আবেদন, এই গ্রন্থে যদি কোনো ভুল ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় তাহলে দলিলসহকারে শুধরে দিলে সংশোধন করে নেবো ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করি আমার এই নগণ্য খেদমতটুকু কবুল করে নাও! এর মাধ্যমে আখেরাতে নাজাতের ব্যবস্থা করে দাও! আমাদের এই জাতিকে তুমি দ্বীনের সঠিক বুঝ সৃষ্টি করে দাও!
এদেশের আকাশে কালেমার সমুন্নত পতাকা যাতে পত্পত্ করে ওড়ে সেই ব্যবস্থা করে দাও! এদেশে কুরআনের বিধান কায়েমের জন্য যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কাজ করছে তাদের হেফাযত করো!
আমার চাকুরিরত অফিসের শ্রদ্ধেয় ম্যানেজার স্যার হাবিবুল্লাহ এবং দেলোয়ার ভাই, তারা আমাকে দীর্ঘ সময় অফিসে অনুপস্থিতির সুযোগ দিয়ে আমার লেখার কাজকে ত্বরান্বিত করেছে এজন্য তাদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। ওমান প্রবাসী বন্ধু হেদায়েত এবং মামাত ভাই ইঞ্জিনিয়ার অপু আমাকে যথেষ্ট প্রেরণা যুগিয়েছে।
সর্বপরি অফিসের সহকর্মী শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই আমার এ উদ্যোগের প্রতি প্রেরণা যুগিয়েছেন, আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন! বলতে হয় আহসান পাবলিকেশনের কথা, তারা পরিশ্রম করে আমার পাণ্ডুলিপিটি সম্পাদনা করেছে, আল্লাহ তাদেরকে জাযায়ে খায়ের দান করুন! আমীন ॥
জাহাঙ্গীর হোসাইন
গুলশান, ঢাকা
মার্চ-২০১৩
আল্লাহর পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি!
১. "হে মানুষ! ভয় কর তোমাদের রব (আল্লাহ) কে; কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার! যেদিন তোমরা উহা প্রত্যক্ষ করিবে সেইদিন প্রত্যেক
স্তন্যদায়িনী মা বিস্মৃত হইবে তাহার দুধের বাচ্চাকে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তাহার গর্ভপাত করিয়া ফেলিবে; মানুষকে দেখিবে নেশাগ্রস্ত মাতাল সদৃশ, কিন্তু আসলে কেউই নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি (যার ভয়ে তারা এমন করছে) কঠিন।’’ (সূরা হজ : ১-২)
২. "হে ঈমানদার লোকেরা তোমরা নিজেদের ও নিজেদের পরিবার পরিজনদের (জাহান্নামের সেই কঠিন) আগুন থেকে বাঁচাও। তার জ্বালানি হবে মানুষ আর পাথর, সেখানে এমন সব ফেরেশতা নিয়োজিত আছে যারা নির্মম হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের, তারা আল্লাহর কোন আদেশই অমান্য করে না, তারা তাই করেন যা তাদেরকে আদেশ করা হয়।’’
(সূরা তাহরীম : ৬)
৩. "যারা ঈমান আনতে অস্বীকার করেছে, (কিয়ামতের দিন) পৃথিবীর সমুদয় ধন-দৌলতও যদি তাদের করায়ত্ত থাকে (তার সাথে আরো) যদি সমপরিমাণ সম্পদ তাদের কাছে থাকে, (এ সম্পদ) মুক্তিপণ হিসেবে দিয়েও যদি তারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পেতে চায় (তাও সম্ভব হবে না), তাদের কাছ থেকে (এর কিছুই সে দিন) গ্রহণ করা হবে না, তাদের জন্য (সেদিন) কঠোর আযাব নির্ধারিত থাকবে।’’ (সূরা মায়েদা : ৩৬)
মানুষ, ঈমানদার, বেঈমান সকলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার যে সতর্কবাণী সেটা সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যেই আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
প্রথম অধ্যায় : সত্যালোকের সন্ধানে
মানব মনের নিভৃতে লুকায়িত প্রশ্ন
পৃথিবীতে বিচরণকারী প্রত্যেক জ্ঞানবান মানুষই চিন্তা করলে বুঝতে পারবে তার চারদিকে সৃষ্টিজগতের বিশাল কারখানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে তার নিজের চোখের সামনে দেখতে পায় এক বিস্তীর্ণ বিশ্বলোকে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই তার মনে প্রশ্ন জাগে : আমি কে? কি এই বিশ্বলোক? তখন সে এই বিশ্ব প্রকৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে নিজেকে ও জগতকে জানবার, বুঝবার জন্য অধীর হয়ে পড়ে। সে তার নিজের প্রকৃতি নিহিত জ্ঞান দ্বারা তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে চেষ্টা শুরু করে দেয়। সে এই জগতে যে সব অবস্থার সম্মুখীন হয়, তার মূল ধারাবাহিকতা কি, তা জানার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে তার মনে যে সব প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, সেগুলোর সঠিক জবাব পাওয়ার জন্যে সে হয়ে পড়ে অস্থির। কিন্তু এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব যে কি, তা সে নিজে মোটেও জানে না।
বস্তুত এ পর্যায়ে মানুষের মনে যে সব প্রশ্ন জাগে সেগুলো কোন কঠিন বা জটিল প্রশ্ন নয়, খুবই সহজ বা সাধারণ প্রশ্ন। সেগুলো হলো, মানুষের স্বভাব, প্রকৃতি ও তার অবস্থার অনিবার্য পরিণতি। এসব প্রশ্ন সব মানুষের মনেই জাগে এবং এর সম্মুখীন হতে হয় প্রতিটি মানুষকে। এ অনন্ত জিজ্ঞাসা, এই সীমাহীন কৌতূহল মানব মনে জাগে বলেই মানুষ নিতান্ত জীব পর্যায়ের নয়, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক সৃষ্টি। এখানেই তার বৈশিষ্ট্য, এতেই তার মর্যাদা। এসব প্রশ্ন শুধু মানব মনেই জাগে এবং এগুলোর জবাব জানবার জন্যেও তাকেই আত্মনিয়োগ করতে হয়। প্রশ্নগুলো এতই প্রবল ও গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলোর জবাব না পেলে কেউ পাগল হয়ে যায়, কেউ আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়, আবার কারো সারা জীবনটাই অতিবাহিত হয় সীমাহীন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। অনেকে আবার এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেয়ে দুনিয়ার আনন্দ-ফুর্তিতে ডুবে গিয়ে নিজেদের মনের অস্থিরতা ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন। তখন তারা হাতের কাছে যা-ই পেয়ে যায় তাকেই কেন্দ্র করে জীবনের কুণ্ডলি পাকায় এবং ভুলে যেতে চায়, যা সে পায়নি। আর এক শ্রেণীর লোক এসব স্বভাবজাত প্রশ্নের ভুল জবাব জানতে পেরে সম্পূর্ণ ভুল পথে চলতে শুরু করে দেয়, বার বার এগিয়ে যায় নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে।
যে প্রশ্নগুলো মানব মনে উদয় হয় তা মোটামুটি তিনটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে, সেগুলো হলো :
১. বিশ্বলোকের স্রষ্টা কে?
২. শাশ্বত সত্তা কে? যার দাসত্ব করা যায়
৩. নিজের পরিণতি কি?
এ তিনটি বিষয়ের একটা শিরোনাম দেয়া যায় ‘সত্যের সন্ধান’ প্রকৃতির
রহস্য উদ্ঘাটন হলো এর প্রধান কাজ এবং পরম ও অনন্য সত্যকে জানা এর চূড়ান্ত লক্ষ্য।
বিশ্বলোকের স্রষ্টা কে?
মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের এ ব্যাখ্যা আধুনিক বিজ্ঞান পেশ করেছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় এমন কতকগুলো ফাঁক রয়ে গেছে, যার কোন জবাব বিজ্ঞান দিতে পারেনি। এ জন্যে এসব মতের প্রচার যত ব্যাপকই হোক না কেন এবং একে যতই চূড়ান্ত বলে ধরে নেয়া হোক না কেন, এই ব্যাখ্যা স্বয়ং বিজ্ঞানীদের মনও কিছুমাত্র পরিতৃপ্ত করতে পারেনি। এই ব্যাখ্যা বস্তুত দৃঢ় প্রত্যয় ও সন্দেহ দূরকারী নয়। মনে রাখা আবশ্যক যে, এগুলো বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণা মাত্র, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।
বিশ্বলোক সৃষ্টিতে বিজ্ঞানের বক্তব্য
বিশ্বলোক সৃষ্টির ধারাবাহিকতা সম্পর্কিত বিশ্লেষণের দু’টো ভিত্তি রয়েছে। একটি হচ্ছে ‘দুর্ঘটনা’ আর দ্বিতীয়টি ধারাবাহিকতা। এই ব্যাখ্যা বলছে, আজ থেকে কোটি কোটি বছর পূর্বে এ বিশ্বলোকের কোন অস্তিত্ব ছিল না। শূন্যলোকে আজকের মত তখন কোন গ্রহ নক্ষত্রও ছিল না। কিন্তু শূন্যলোকে সূক্ষ্ম বিন্দু অণুর একটা পুঞ্জীভূত মেঘমালা সারা বিশ্বলোকে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। এ সময় ‘বস্তু’ বা ‘জড়’ সম্পূর্ণ ভারসাম্যযুক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাতে কোনরূপ গতি বা কম্পন ছিল না। গাণিতিক দৃষ্টিতে সে সুষমতা ছিল এমন যে, তাতে বিন্দু পরিমাণ ব্যতিক্রম ঘটলেও আর তা অবশিষ্ট থাকতে পারে না। সে ব্যতিক্রম বৃদ্ধিই পেতে থাকবে। এই প্রাথমিক ব্যতিক্রম যদি স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে এ বিশ্লেষণে উপস্থাপকদের ধারণা তার পরবর্তী সব ঘটনা গণিত-বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সহজেই প্রমাণিত হবে। কার্যত হলোও তাই, এ পুঞ্জীভূত জড়ে সামান্যতম ব্যতিক্রম ঘটে গেল। যেমন পুকুরের নিটোল পানি যদি কেউ নেড়ে দেয় অথবা একটা ঢিল ছোঁড়ে, তাহলে তরঙ্গের একটা নিরবচ্ছিন্ন ক্রমিক ধারা ছুটতে থাকে। অত:পর তাই ঘটতে লাগল। কিন্তু প্রশান্ত মহাশূন্যের ‘পুকুরে’ কে প্রথম কম্পন আর তরঙ্গ জাগিয়ে দিল, সে বিষয়ে কিছু জানা নেই। যে কম্পন ও তরঙ্গ উঠেছে তা নিরন্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ‘জড়’ সংকুচিত হয়ে নানা জায়গায় দানা বাঁধতে ও পুঞ্জীভূত হতে শুরু করল। আর এই দানা বাঁধা ও পুঞ্জীভূত হওয়া বস্তুকেই আমরা বলি গ্রহ, নক্ষত্র বা নীহারিকা।
বিজ্ঞানের গ্রন্থাবলীতে বিশ্বজগতের জন্ম রহস্য যেভাবে পাওয়া যায় তা হল : বিজ্ঞানের ভাষায় আগুনের শিখা, ধুলা-বালি, গ্যাস এবং বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের ধাতব মিশ্রণের ধোঁয়া বা মেঘপুঞ্জকে ‘নেবুলা’ (Nebula) বলা হয়। এই নেবুলা হচ্ছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কাঁচামাল। প্রতিটি নেবুলা থেকে প্রায় গড়ে ২০,০০০ কোটি নক্ষত্র এবং তাদের সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়। আমাদের এই মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৫০০ কোটি বছর পূর্বে প্রচণ্ড ঘনায়নকৃত এক মহাসূক্ষ্ম বিন্দুতে (Big bang) বিগ ব্যাংগ নামক মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। আদি নেবুলা এর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জ, তারপরও সর্বত্র একত্রে থেকে গেছে নেবুলার বহুলাংশ। ঐ অবশিষ্ট নেবুলা এবং নত্রক্ষপুঞ্জকে বর্তমানে ‘গ্যালাক্সী’ হিসেবে চিিহ্নত করা হয়ে থাকে। আমাদের মাতৃ-গ্যালাক্সীর নাম (Milky way) ‘মিলকিওয়ে’। মহাবিশ্বে অসংখ্য গ্যালাক্সী আছে। প্রতিটি গ্যালাক্সীতে গড়ে প্রায় ২০,০০০ কোটি নক্ষত্র এবং অগণিত নেবুলা বিদ্যমান। আরেক প্রকার নেবুলা হচ্ছে : পুরাতন এবং প্রচণ্ড বেগে আবর্তনশীল নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ। ছোট বা মাঝারি ধরনের নক্ষত্রের চাইতে বড়-বৃহৎ নক্ষত্র বা ‘সুপার নোভা’ (Super nova) বিস্ফোরণের মাধ্যমে নক্ষত্রগুলো তাদের ভেতরকার বস্তুসম্ভার যা প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাসীয় অবস্থা ধারণকৃত, তা বাইরের দিকে নিক্ষেপ করে। তখন তাপমাত্রা প্রায় ৪,০০০০০০প (চার লক্ষ ডিগ্রি) পর্যন্ত উঠে যায়। উল্লেখ্য আমাদের সৌরজগতের প্রধান সূর্য, যার তাপমাত্রা ৬০০০০প (ছয় হাজার ডিগ্রি)। যার কাছে আমাদের পৃথিবীতে তৈরি নভোযান গেলে অস্তিত্বহীন হয়ে গলে যাবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন : মহাশূন্যে যা কিছু আবিষ্কার হয়েছে তা হিসাব করতে গিয়ে মাইল/কিলোমিটারে সম্ভব নয় সেজন্য আলোকবর্ষের সাহায্য নিতে হয়। আলোকবর্ষ হলো সেই জিনিস, প্রতি সেকেণ্ডে আলোর গতি হলো ১,৮৬,০০০ মাইল, এই গতিতে যদি এক বছর সময় পর্যন্ত আলো চলতে থাকে তাহলে যত পথ হয়, তত পথ হলো ১ আলোকবর্ষ। তাহলে ১ আলোকবর্ষ = ১৮৬০০০ x ৬০ x ৬০ x ২৪ x ৩৬৫ = ৫,৮৬,৫৬৯,৬০০০০০০ বা প্রায় ৬ লক্ষ কোটি মাইল। এখন আসি অন্য কথায়। উক্ত আলোকবর্ষের যে মাপ দেখানো হলো, সেই আলোকবর্ষের হিসাবে বিজ্ঞানীরা তাদের টেলিস্কোপে ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের কথা বলেছেন। তাছাড়াও এর বাহিরে প্রায় আলোর গতির মত গতি নিয়ে মহাবিশ্ব প্রসার লাভ করছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত মহাশূন্যে ১০০ কোটির মত গ্যালাক্সী আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি গ্যালাক্সীতে গড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি নক্ষত্র বা তারকা রয়েছে। এবার মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে দেখুন কত বিশাল।
মানব সমাজ ধাপে ধাপে জ্ঞানের প্রসারতা লাভ করে এই মহাবিশ্বে অসংখ্য অদৃশ্য অজানা বস্তুর উদ্ঘাটন করে চলেছে, যা একদিকে বিস্ময়কর এবং অপরদিকে লুকায়িত ‘মহাসত্যকে’ দর্শনলাভে সহায়কও বটে।
এবার আসি সূর্য এবং আমাদের পৃথিবী সম্পর্কে কিছু কথায়। পৃথিবীর ব্যাস ১২,৭৫৬ কিলোমিটার। পৃষ্ঠদেশে যার গড় তাপমাত্রা হল ১৫০প। পৃথিবী সূর্যের তিন নম্বর কক্ষের গ্রহ, সূর্য থেকে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৃথিবীর আগের গ্রহ হল, শুক্র। এই শুক্র গ্রহ সূর্য থেকে ১০ কোটি ৮০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে ৫ কোটি কিলোমিটার সূর্যের কাছাকাছি অবস্থান হওয়ার কারণে যার তাপমাত্রা ৪৮২০প। যদি ১০০০প তাপমাত্রা পৃথিবীতে হতো তাহলে প্রাণীজগৎ সব মরে শেষ হয়ে যেত। আবার সূর্য থেকে যদি দূরে হতো যেমন মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব সূর্য থেকে ২২ কোটি ৮০ লক্ষ কিলোমিটার যার কারণে তার তাপমাত্রা -৬৩০প। সেখানে প্রাণীজগৎ থাকলে সব হীম শিতল হয়ে মারা যেত, বেঁচে থাকতে পারতো না।
প্রায় ১ সে.মি. থেকে ১ হাজার কিলোমিটার ব্যাসসম্পন্ন অগণিত ভাসমান পাথরের স্তূপ মহাশূন্যে বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহের মাঝে পরিভ্রমণ করছে। মহাজাগতিক কারণে মাত্র ১ কিলোমিটার ব্যাসসম্পন্ন একটি পাথরের উড়ন্ত আঘাতেও পৃথিবীর ইতিহাসকে চিরদিনের জন্য মুছে দিতে পারে। মাত্র ১ কিলোমিটার ব্যাসের একটি উড়ন্ত পাথরের আঘাতই মনোরম সাজে সাজানো পৃথিবীকে ধুলিকণায় পরিণত করবে। নিশ্চিহ্ন করে দিবে সকল প্রাণ। পৃথিবীর চতুর্দিকে এক সে. মি. হতে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার ব্যাস সম্পন্ন অসংখ্য পাথর প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে।
এখন প্রশ্ন হল, পূর্বে যা কিছু বিজ্ঞান থেকে উল্লেখ করা হলো পৃথিবী এবং জগৎ সম্পর্কে তা তো একা একা সৃষ্টি হতে পারে না। বিগ ব্যাংগ এর যে থিউরি পূর্বে পেশ করা হয়েছে, তাতে যে প্রচণ্ড ঘনায়নকৃত এক মহাসূক্ষ্ম বিন্দুতে বিগ ব্যাংগ নামক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টির সূচনা হয়েছে। কিন্তু উক্ত ঘনায়নের ভেতরে মহাবিস্ফোরণটা ঘটালো কে? নিশ্চয় তার একজন স্রষ্টা আছে এবং সে স্রষ্টা সকল কিছুর উপরে পরাক্রমশালী, সর্বশক্তিমান, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণতকারী।
শাশ্বত সত্তা কে? যার দাসত্ব করতে হবে
মানুষের দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আমার দাসত্ব পাওয়ার যোগ্য কে? বস্তুত মানুষ নিজের জীবনে একটা বিরাট শূন্যতা মর্মে মর্মে অনুভব করে। কিন্তু সে শূন্যতা পূর্ণ করার উপায় যে কি, তা সে জানে না। শূন্যতার এই তীব্র অনুভূতিকেই এখানে কার দাসত্ব করতে হবে বলে উল্লেখ করা হলো। শূন্যতার এ অনুভূতি দু’টো দিক দিয়ে মানুষকে দুর্বল করে দেয়। আমরা নিজেদের জীবন সত্তা ও বাইরের জগৎ সম্পর্কে যখন চিন্তা করি, তখন আমাদের মনে দু’টো আবেগ জেগে ওঠে। এর একটি হল, কৃতজ্ঞতার আবেগ, আর দ্বিতীয়টি হলো নিজেদের দুর্বলতা ও অক্ষমতার অনুভূতি।
আমাদের জীবনের যে দিকেই দৃষ্টিপাত করি, আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই আমাদের উপর দয়া, অনুগ্রহ ও অবদানের কোন সীমা পরিসীমা নেই। দয়া, অনুগ্রহ ও অবদানে আমাদের গোটা জীবন সত্তাই আচ্ছন্ন হয়ে আছে, চলছে তার অবিরাম বর্ষণ। তা দেখে এসবের দাতার প্রতি আমাদের হৃদয় সীমাহীন কৃতজ্ঞতাই ভরে ওঠে। মনে এ ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে যে, আমাদের সর্বোত্তম আনুগত্য ও দাসত্ব সেই অনুগ্রহকারীর সমীপে সবিনয়ে উৎসর্গ করি, নিজেকে নি:শেষ করে ঢেলে দেই তাঁরই উদ্দেশ্যে। এ দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বলোকে সৃষ্টিকর্তার সন্ধান আমাদের জন্যে গভীরভাবে প্রয়োজন। স্রষ্টা কে? বিশ্বের পরিচালক কে? এ প্রশ্ন আমাদের একটা বাহ্যিক সমস্যার সমাধানে প্রশ্ন নয়। মূলত এ হচ্ছে আমাদের জীবন সত্তার অভ্যন্তরীণ দাবি। আমাদের গোটা সত্তাই এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য ব্যাকুল।
মানুষ নিজেকে এই বিশ্বলোকে জীবন্ত দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে তার নিজের চাওয়া-না চাওয়ার বিন্দুমাত্র অংশ নেই। মানুষ নিজেকে এমন একটা পূর্ণাঙ্গ দেহ-সম্পন্ন দেখতে পাচ্ছে, যার চাইতে উত্তম দেহ সত্তার সে কল্পনাও করতে পারে না। এই দেহ সে নিজে রচনা করেনি, নিজের প্রয়োজন অনুপাতেও সে একে প্রয়োজনীয় সুসজ্জিত করেনি অথচ এর একটা অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গও তার জন্য অকেজো বা অপ্রয়োজনীয় নয়। এর যেকোন একটার অনুপস্থিতি বরং তাকে অসম্পূর্ণ, অক্ষম বা পঙ্গু করে দিত। মানুষ তার অভ্যন্তরে মন মগজে এমন সব প্রতিভার উপস্থিতি অনুভব করছে, যা এ দুনিয়ার অপর কোন জীব বা প্রাণীর নেই অথচ এসব শক্তি, প্রতিভা এবং যোগ্যতা অর্জনের জন্যে সে কিছুই করেনি, সাধ্যও তার ছিল না। আমাদের এই সত্তা আমাদের নিজস্ব সম্পদ নয়, এটা সম্পূর্ণভাবে দান বিশেষ। কিন্তু এ দানের দাতা কে? কোন্ সে মহান সত্তা যা আমি না চাইতেই এবং আমার কোন চেষ্টা ছাড়াই আমাকে এসব নিজ থেকেই দান করলেন? যিনিই তা করে থাকুন, তিনি যে নিজগুণেই মহান এবং অনন্য সাধারণ শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী, তাতে তো কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। সন্দেহ থাকতে পারে না তারও, যার আছে এরূপ অনুভূতি, এরূপ উদার ও মুক্ত মন ও মানসিকতা। তাই আমার প্রতি এসব অনুগ্রহ কার অবদান, এ প্রশ্ন আমার মনের গভীরে সোচ্চার। আমার গোটা সত্তা, সমস্ত প্রকৃতিই এ প্রশ্নের জবাব নি:সন্দেহে পেতে চায়, যেন আমি আমার এ মহা অনুগ্রহকারীর প্রতি হৃদয়ের অন্ত:স্থল থেকে যথোপযুক্ত কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি। এ প্রশ্নের গুরুত্ব কোন ন্যায়পরায়ণ মানুষ অস্বীকার করতে পারে না।
শুধু শরীরই নয় শরীরের বাহিরে একটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চাই। লক্ষ্য করুন, বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে আমাদের কল্যাণের জন্য যা কিছু আছে তার একটি হলো পানি। যে পানির অপর নাম হলো জীবন। পানি সম্পর্কে একটু চিন্তা করা যাক। প্রত্যেকটি তরল পদার্থ অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় জমাট বেঁধে যায়। কোন তরল পদার্থ অল্প ঠাণ্ডায় জমে যায় আবার কোন তরল পদার্থ খুব বেশি ঠাণ্ডায় জমে। প্রায় সকল তরল পদার্থই অতি ঠাণ্ডায় জমাট বেঁধে যায়। প্রত্যেক তরল পদার্থ জমাট বেঁধে একটা শক্ত শিলার ন্যায় বা বরফের চাকার মতো হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি জমাট বাঁধা জিনিস সেই জাতীয় তরল পদার্থের মধ্যে ছেড়ে দিলে ডুবে যায়। যখন নারিকেলের তেল বোতলের মধ্যে জমাট বেঁধে থাকে তখন আগুনের তাপের উপর ধরলে দেখা যাবে যেটুকু গলে যাবে সেটুকু উপরে উঠে যাবে, আর যেটুকু জমাট বাঁধা অবস্থায় থাকবে সেটুকু নিচে নেমে যাবে। এই থেকে বুঝা গেল, তরল পদার্থের মধ্যে সেই জাতীয় জমাট বাঁধা অংশ নিচে পড়ে যায়, উপরে ভাসে না। কিন্তু একমাত্র পানির বেলায়ই শুধু ব্যতিক্রম।
কিছু অঞ্চলে এমনও নদী আছে, যে নদীর পানি ঠাণ্ডায় জমে যায়। তার অর্থ এ নয় যে, পানির নিচের তলা পর্যন্ত জমে যায়। পানির উপরের ৩ ফুট বা ২ ফুট পুরু হয়ে উপরের অংশ জমে। আর নিচের পানি তরলই থাকে। ফলে উপরের জমাট বাঁধা পানির কঠিন বরফের শিলা স্রোতে আস্তে আস্তে ভাটির দিকে যেতে যেতে একেবারে সমুদ্রে পৌঁছে যায়। যদি জমাট বাঁধা বরফের চাকা অন্যান্য তরল পদার্থের ন্যায় জমাট বাঁধা চাকার মতো পানিতে তলিয়ে যেত, তাহলে পানির ভেতরের সামুদ্রিক জীবগুলো চাপা পড়ে মরে যেত।
এছাড়া বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে শুষ্ক মরা জমিনে ফসল, লতাপাতা, গাছ-গাছালিসহ নানা জীবের প্রাণ ধারণের ব্যবস্থাসহ নানাবিধ উপকার হয়। যা আমাদের সকলেরই জানা কথা।
বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে আমাদের কল্যাণের জন্য সংরক্ষিত অসংখ্য ব্যবস্থার মধ্য থেকে এখানে মাত্র একটির কথা সংক্ষেপে বলা হলো। আরো যে হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ ব্যবস্থা রয়েছে তাদের উল্লেখ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ প্রতি মুহূর্ত এসব ব্যবস্থার বাস্তব সুবিধা ভোগ করছে। এদের কোন একটিও না থাকলে মানুষের জীবন শুধু অচলই নয়, অসম্ভব হয়ে পড়বে। এসব ব্যবস্থা ছাড়া এ দুনিয়ার বুকে মানুষের জীবন, সভ্যতার কল্পনাও করা যায় না। এরূপ অবস্থায় মানুষ সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চায়, এই বিরাট বিপুল ব্যবস্থাপনা কার অবদান?
নিজের পরিণতি কি?
মহাসত্যের সন্ধানের তৃতীয় পর্যায় হলো মানুষের পরিণাম ও পরিণতির সন্ধান। মানুষ জানতে চায়, সে কোথা থেকে এখানে এল এবং এখান থেকে কোথায় যাবে? সে নিজের মধ্যে অনুভব করে বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা। সেগুলোর পরিতৃপ্তি কিরূপে হবে তা সে জানতে চায়। সে পেতে চায় বর্তমান সীমাবদ্ধ জীবনের তুলনায় এক অনন্ত জীবন। কিন্তু তা কোথায় পাওয়া যাবে তা সে জানে না। মানুষের মধ্যে রয়েছে বহু নৈতিক ও মানবীয় অনুভূতি কিন্তু তার প্রায় সবই এখানে উপেক্ষিত, অবহেলিত। তাহলে মানুষ কি তার মনের মত জগৎ পাবে না? এই প্রশ্ন মানব মনে কেন উদয় হচ্ছে, দানা বাঁধছে, তার বিশ্লেষণ হতে পারে- বিশ্বপ্রকৃতির অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।
বিশ্ব-প্রকৃতির অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ
এ পর্যায়ে আরো একটা কথা তীব্রভাবে মনে জাগে। মানুষের জীবন যদি দুনিয়াতেই নি:শেষ হয়ে যায় এবং তারপর আর কিছুই না থাকে তাহলে বলতে হবে এ ক্ষণস্থায়ী জীবন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। মানুষ চায় দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে। মৃত্যু কারোরই কাম্য নয়। সে পেতে চায় সব দু:খ, ব্যথা ও কষ্ট থেকে মুক্তি এবং সুখ-সমৃদ্ধিপূর্ণ জীবন। কিন্তু প্রকৃত সুখ লাভ কি এখানে কারো পক্ষেই সম্ভব? তা সম্ভব নয়, কারণ সবার জন্য মৃত্যু অবধারিত। বৈজ্ঞানিক ধারণার ১৫০০ কোটি বছর পূর্বে সৃষ্টি হওয়া মহাবিশ্ব, ১২০০ কোটি বছর পূর্বে সৃষ্টি হওয়া সূর্য, ৫০০ কোটি বছর পূর্বে সৃষ্টি হওয়া পৃথিবী, ১২৩ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব হওয়া এবং মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার বছর পূর্বে মানুষের আবির্ভাব। তাও আবার প্রত্যেক নিজ নিজ জীবনের দিকে চিন্তা করলে দেখা যায় পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত জন্ম নেয়া মানুষের গড় আয়ু হয়ত ১০০ বছরের বেশি হবে না। এ সীমাবদ্ধ ও নশ্বর জীবনে সে কামনা-বাসনার কিছুই পায় না। মানুষ সত্যই যা কিছু চায়, কামনা করে, এই বস্তুজগৎ তা পাওয়ার কোনই অনুকূল নয়। আশার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে গেলেই মানুষ বাধার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। বিশ্বলোক মানুষের পক্ষে খানিকটা বেশ অনুকূল, তারপরই প্রতিকূল। তাহলে এই জগতটা কি মানুষের জন্য বানানো হয়নি? মানুষ কি এই জগতে ভুলবশতই এসেছে, পথভুলে? যে জগৎ তার জন্য বানানো হয়নি, তাকেই কি সে ভুল করে ‘আপনার’ করে পেতে চেয়েছে? মানুষের সমস্ত কামনা-বাসনা, চিন্তা ও কল্পনা কি নিতান্তই অবাস্তব? মানব মনে যে সব কামনা-বাসনা জাগে তাকি শুধু এজন্য যে, তা নিয়ে মানুষ কাজ করবে ও চলে যাবে? বিগত হাজার হাজার বছর ধরে মানব মনে যেসব অনুভূতি জেগেছে, তার কোন মনযিল নেই? অতীতে কি তার কোন ভিত্তি নেই, নেই ভবিষ্যতে কোন স্থিতি ও বাস্তবতা? অথচ বিশ্বলোকে মানুষই এমনজীব, যার আগামীকাল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে ভবিষ্যতকে উত্তম ও উন্নত করে গড়ে তুলতে পিপীলিকাও ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে, বাবুই পাখি বাসা বানায়। কিন্তু ওদের এ কাজ তো সচেতনভাবে নয়, নিতান্তই অবচেতনভাবে, স্বভাবগত অভ্যাস হিসেবে। খাদ্য সঞ্চয় করে রাখার কিংবা নীড় রচনার পেছনে ওদের বিবেক বুদ্ধির কোন সচেতন সিদ্ধান্ত থাকে না। এ ক্ষমতা একমাত্র মানুষেরই রয়েছে এবং সচেতনভাবে মানুষই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। তার আয়োজনে চেষ্টা করে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে এটাই পার্থক্য। জন্তু জানোয়ারের ক্ষেত্রে আজকের জীবনটাই একমাত্র জীবন। ওদের জীবনে ‘কাল’ বলতে কিছু নেই। তাহলে মানুষের জীবনেও ‘কাল’ বলতে কিছু নেই? তাই যদি হয়, তাহলে বলতে হবে, এটা স্বাভাবিক নয়। মানব মনে ভবিষ্যতের চিন্তা