Discover millions of ebooks, audiobooks, and so much more with a free trial

Only $11.99/month after trial. Cancel anytime.

মা (মা-বাবার প্রতি আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়) / Maa (Bengali)
মা (মা-বাবার প্রতি আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়) / Maa (Bengali)
মা (মা-বাবার প্রতি আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়) / Maa (Bengali)
Ebook1,276 pages8 hours

মা (মা-বাবার প্রতি আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়) / Maa (Bengali)

Rating: 5 out of 5 stars

5/5

()

Read preview

About this ebook

বইটির মূল বিষয়বস্তু মা-বাবা। এ বিষয়ে অনেক বই রয়েছে। মা-বাবার হক্ বা কর্তব্য বিষয়ক অন্যান্য বই-এর মতো এটি নয়। সমাজের জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। লেখক মা-বাবা প্রসঙ্গে একটা গবেষণামূলক ব্যতিক্রমধর্মী জরিপও সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছিলেন। আসলেও যে সব মা-বাবা অতি বৃদ্ধ বয়সে অচল-অসহায় হয়ে পড়ে। নড়াচড়ারও ক্ষমতা থাকে না। তখন তাঁদের পরিচর্যা ও দেখাশোনার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়ে বসে। ঐ সময় এ ব্যাপারে উপেক্ষিত হলেই তাঁদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এজন্যই তাঁদেরকে নিগৃহীত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
গ্রন্থটি মাতা-পিতার প্রতি সৎ-ব্যবহার এবং কর্তব্য সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার একটি সৎ-প্রচেষ্টা। এতে অসৎ বা দুর্ব্যবহারের কিছু প্রতিক্রিয়ার কথাও তুলে ধরা আছে। পবিত্র কোরআন এবং হাদীসসমূহ থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে বিস্তৃত আলোচনা, মাতা-পিতার অবস্থান এই পুস্তকে সন্দেহাতীত করে তুলেছে।

LanguageBengali
Release dateApr 30, 2015
ISBN9781311043511
মা (মা-বাবার প্রতি আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়) / Maa (Bengali)

Related categories

Reviews for মা (মা-বাবার প্রতি আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়) / Maa (Bengali)

Rating: 5 out of 5 stars
5/5

1 rating0 reviews

What did you think?

Tap to rate

Review must be at least 10 words

    Book preview

    মা (মা-বাবার প্রতি আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়) / Maa (Bengali) - মুহাম্মাদ মকসুদ আলী Muhammad Moksud Ali

    তোহফা

    আল্লাহ তা‘আলার অপার মহিমায় যার উসিলায় আমার পয়দায়েশ। যার উসিলায় জগতে আমি প্রথম আলো দেখলাম। সূতিকাগারে প্রসব বেদনার তীব্র যন্ত্রণা থেকে জন্মাবধি দিনের পর দিন অপরিসীম ক্লেশ আর যাতনা সয়ে যিনি আমায় লালন করেছেন। তিনি আমার ‘জন্মদায়িনী’। তিনিই আমার ‘উম্মুন মা’। আমার সেই পরম স্নেহময়ী মমতাময়ী ‘‘মা’ এবং পরম ভক্তিভাজন ‘পিতা’র পবিত্র রূহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে।

    - লেখক নাচীজ

    অভিমত

    উম্মুন-মা (মাতা-পিতার প্রতি আচরণ ও তার প্রতিক্রিয়ার বিষয়) গ্রন্থটি মাতা-পিতার প্রতি সৎ-ব্যবহার এবং কর্তব্য সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার একটি সৎ-প্রচেষ্টা। এতে অসৎ বা দুর্ব্যবহারের কিছু প্রতিক্রিয়ার কথাও তুলে ধরা আছে। পবিত্র কোরআন এবং হাদীসসমূহ থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে বিস্তৃত আলোচনা, মাতা-পিতার অবস্থান এই পুস্তকে সন্দেহাতীত করে তুলেছে।

    বর্তমান সমাজ জীবনে পারিবারিক সম্পর্ক দিনে দিনে যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবান্বিত হয়ে মাতা-পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে আত্মীয়-আপনজনের সম্পর্কেও একই অবস্থা। এমন একটি পরিস্থিতিতে ‘মা’ একটি পথ-নির্দেশক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে আশা রাখি।

    ডা. নুরুল ইসলাম

    জাতীয় অধ্যাপক

    প্রতিষ্ঠাতা-প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (ইউএসটিএস)

    প্রকাশকের কথা

    উম্মুন-মা বইটির মূল বিষয়বস্তু মা-বাবা। এ বিষয়ে অনেক বই রয়েছে। মা-বাবার হক্ বা কর্তব্য বিষয়ক অন্যান্য বই-এর মতো এটি নয়। বইটি ব্যতিক্রম বিধায় প্রকাশে আগ্রহী হই। সমাজের জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। লেখক মা-বাবা প্রসঙ্গে একটা গবেষণামূলক ব্যতিক্রমধর্মী জরিপও সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছিলেন। আসলেও যে সব মা-বাবা অতি বৃদ্ধ বয়সে অচল-অসহায় হয়ে পড়ে। নড়াচড়ারও ক্ষমতা থাকে না। তখন তাঁদের পরিচর্যা ও দেখাশোনার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়ে বসে। ঐ সময় এ ব্যাপারে উপেক্ষিত হলেই তাঁদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এজন্যই তাঁদেরকে নিগৃহীত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

    এক সময় ঐসব অচল বরেণ্য ব্যক্তিরাই সমাজে, পরিবারে নিজ সন্তান-সন্ততির জন্য অনেক অবদান রেখে এসেছেন। যে সব পরিবার ঐ অসহায়দের দুর্ভোগ উত্তরণে সফল হয়েছে, তাঁরাই উত্তম। আল্লাহ পাকের কাছে নিশ্চয়ই তাঁরা পুরস্কারপ্রাপ্ত হবেন।

    এই বইটি প্রকাশ ও প্রচারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সফলতা কামনা করছি।

    প্রকাশক

    কৃতজ্ঞতা

    একজন মাতৃভক্তের কাছে উম্মুন ‘মা’-এর ভূমিকা লিখে দিতে আরজি পেশ করা হলো। ‘মা’ কথাটি শুনেই তাঁর হৃদয়-মন মথিত হয়ে পড়ে। তিনি ‘মা’ পাণ্ডুলিপিটি দু’দিনের জন্য রেখে, ব্যস্ততার মাঝেও অংশবিশেষ পাঠ করেছেন। মূল্যবান সময় ব্যয় করে ভূমিকা লিখে দিলেন এবং না’চীজ অধমকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন।

    তিনি আর কেউ নন, আমাদেরই দেশের একজন সমাদৃত ব্যক্তিত্ব। অতি ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিত্যদিন ‘মা’-এর খেদমত করতেন। মায়ের সাহচর্যে গিয়ে কুশল জানতেন। বাবাকে অনেক আগেই হারিয়েছেন। যতদিন তাঁর স্নেহময়ী পুণ্যবতী জননী জীবিত ছিলেন-ততদিন তিনি সেবা-যত্নে সচেতন ছিলেন। ত্রুটি হতে দেননি। বাইরে গেলে মায়ের সম্মতি এবং খোঁজ নিয়ে যেতেন। আবার এসেই উপস্থিতি জানিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসতেন। সহনশীল মনোভাবে কথা বলতেন। গায়ে মাথায় হাত বুলতেন। অনুপস্থিতকালে কষ্ট হয়েছিল কিনা জানতে চাইতেন। মা মাথা নেড়ে জবাব দিতেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়তেন। আদবী আচরণে খুশী হয়ে, মা ছেলের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করতেন। সেই মাতৃভক্ত তার মায়ের সাথে এমনি মিষ্টি আচরণে মমতায় ভরিয়ে দিতেন। ধানমন্ডির যে বাড়িতে তিনি অবস্থান করছেন। সে বাড়ির ফটকেও মায়েরই নাম শোভা পাচ্ছে। মায়ের নাম দিয়ে বাড়ির নামকরণ করেছেন গুলমেহের।

    পুণ্যবতী মায়ের সেই যোগ্য সন্তান, দেশের গৌরব, স্বাধীনতা পরবর্তী জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান পুরুষ প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম সাহেব।

    কিন্তু দু:খের বিষয় জানাতে হচ্ছে যে, পরবর্তীতে গত ২৪শে জানুয়ারী ২০১৩ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে পরলোকে চলে গেলেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন)। মায়ের নামে গুলমেহের বাসভবন থেকে নিকটস্থ ল্যাব এইড হাসপাতালে পবিত্র জুমারাতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জীবদ্দশায় মুদ্রিত কপিটা হাতে তুলে দিতে না পারায় পশ্চাৎমনে একটা বেদনা রয়ে গেল।

    সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদের খেদমতে আরজ : উম্মুন-মা (মাতা-পিতার প্রতি আচরণ ও তার প্রতিক্রিয়ার বিষয়) গ্রন্থটি অন্তত: একবার পাঠ করুন। সাধারণত আমরা কিতাবাদি বা বইপত্র হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখি। তার ছবি ছাপা শিরোনাম দেখি। কিতাবের শরীর জুড়ে লাভজনক- তৃষ্ণা নিবারণের মত আকর্ষণীয় কিছু আছে কিনা। বিক্রেতার বিরক্তি ভাজন হয়েও আমরা ঐ সব বিষয় খুঁজতে থাকি। অথচ আদ্যোপান্ত পাঠ করা বা তার থেকে কিছু অর্জন করার সদিচ্ছা পাই না। কিতাবটি হ’তে মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহারের সহায়ক ও আল্লাহর দরবারে মকবুল হওয়ার জন্য দোয়া করছি। সকল শ্রদ্ধাভাজন মাতা-পিতার জন্যেও দোয়া করুন। না’চীজ লেখক বা এই অকৃতজ্ঞর মা-বাপের জন্যেও একটু দোয়া করুন। আমার সকল সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, বুজুর্গানে দ্বীন, দ্বীন শিক্ষায় যাঁদের সহায়তা পেয়েছি ও স্বীয় মুরুব্বীয়ানদের জন্যেও দোয়া করুন।

    অত:পর আসুন, আমরা মাতা-পিতার ব্যাপারে সচেনত হই। মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার, তাঁদেরকে সন্তুষ্ট রাখা বা না-রাখার ব্যাপারে যদি উদাসীন থাকি। তাহলে আমাদেরকে এর পরিণতি ভোগ করে যেতে হবে। তাই মাতা-পিতা উভয়কে অথবা কোন একজনকে জীবিত পেয়ে আমরা যারা আজও সৌভাগ্যবান। তারা ইতোপূর্বে তাঁদের সাথে যে আচরণই করে থাকুন। তাঁদের প্রতি বিনয়ের সাথে অনুরোধ নিজেদের ইহ-পরকালের কল্যাণের কথা ভেবে- তারা মা-বাবার কাছে অসদাচরণের দায় এড়াতে সত্বর ক্ষমা চেয়ে নিন। অত:পর আল্লাহর দরবারে তওবা করুন। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, করুণাময়, তিনি গাফ্ফার-রাহমানুর রহীম। তিনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন।

    অতএব কিতাবটি হাতে পেয়ে আদ্যোপান্ত পাঠ করুন। পাঠ শেষে যদি কেউ মা-বাপের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। পরম স্নেহময়ী মমতাময়ী মাতা ও শ্রদ্ধাভাজন পিতার প্রতি খেদমত বা সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াসী হোন। যাদের মাতা-পিতা পরলোক গমন করেছেন যদি তাঁদের বিদেহী আত্মার সন্তুষ্টি কামনা করেন। তাঁদের নাজাতের জন্য দোয়া ইস্তেগফার করতে থাকেন। তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে খেদমতের অন্তর্ভুক্ত করবেন এবং সেই সব পরলোকগত মাতা-পিতাকে নিশ্চয়ই নাজাত দান করবেন। ঐ সব খেদমতগুজার সন্তানদের প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। সেই সাথে উম্মুন মা-এর জন্য যারা সহযোগিতা করেছেন, মেধা-মনন ও মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন। আল্লাহ পাক সেই সব গুণিজনদের প্রতি সদয় হোন। স্বীয় পরিবারে ডা: মামা হিসেবে সংশ্লিষ্ট ইসলামীয়া আরোগ্য সদন হাসপাতালের এম-ডি ড. মুহাম্মাদ আমীরুল ইসলাম পি.এইচ.ডি সাহেবও তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। ভূমিকা লিখে প্রফেসর নুরুল ইসলাম সাহেব আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। যাঁরা দোয়া ও মতামত দান করেছেন তাঁদের প্রতিও। ঐসব মহৎ প্রাণ ব্যক্তিত্বদের নসিহতও আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।

    বেশ কয়েক বছর আগে আমার এক স্নেহভাজন ও মাতৃভক্ত সহকর্মী ইসতিয়াক চৌধুরী ফিরোজ-এর সাথে ধানমন্ডিস্থ ইসলামীয়া আরোগ্য সদন হাসপাতালে যাই। সেখানে খানকায়ে বোরহানীয়াতে হাসপাতালের এম-ডি সাহেব কর্তৃক দ্বীনি আলোচনা, যিকির-আযকার, বিশেষ করে ঐ মাহফিলে মাতা-পিতার প্রতি আলোকপাত করে দোয়া ও মাগফিরাত কামনা করা হয়। প্রতিদানে আল্লাহ তা‘আলার পুরস্কার ও তিরস্কার সম্বন্ধেও সকলকে অবহিত করা হয়।

    এছাড়া মা-বাবার উপর জরিপে অনেক জায়গা থেকে ঐ মা-বাবার নিগৃহীত হ’বার সংবাদ প্রাপ্ত হই। সংবাদপত্রেও মাঝে মধ্যে মা-বাবার প্রতি সন্তানদের অসদাচরণ ও বিরোধের জের ধরে মাতৃহন্তা পিতৃহন্তার খবর পর্যন্ত নজরে আসে। অত:পর আরোগ্য সদনে যাতায়াতে সাপ্তাহিক মাহফিলে যুক্ত হই। ‘উম্মুন-মা’ এর ব্যাপারে দীর্ঘ দিন ধরে লেখার সদিচ্ছা থাকলেও মূলত: আগের ঘটনাগুলো থেকে এবং এখানেই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে লেখার প্রতি অনুপ্রাণিত ও তাগিদ অনুভব করি। কিন্তু এগুতে গিয়েও মাঝপথে থেমে যাই। নিজের শত অযোগ্যতা, অর্থকষ্ট ও দ্বিধা-সংকোচে দীর্ঘ দিন কেটে যায়। অত:পর হায় আফসোস-পরম প্রিয়জন নিজ মা-বাবাও একান্ত কাছে থেকে পরলোকে হারিয়ে গেলেন। তাঁদের কথা স্মরণ হলেই মনটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভরে ওঠে। এসব নানা কারণে প্রকাশনায় বিলম্ব ঘটে যায়।

    এরপর মা-বাবার উপর জরিপ ও ‘উম্মুন-মা’ বইটির ব্যাপারে যাঁদের কাছেই গেছি। বিভিন্নভাবে সমাধান চেয়েছি, প্রশ্ন রেখেছি- তাঁরা অকাতরে সেসব জটিলতার সম্ভাব্য সমাধান দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সর্বজনাব ড. মুহাম্মাদ আমিরুল ইসলাম, হাফেজ ক্বারী মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল হোসেন, খতীব বড় মসজিদ করটিয়া। মাওলানা মুহাম্মাদ মোজাম্মেল হক মাসুম, মুফতী মাওলানা মুহাম্মাদ আমিনুর রহমান, প্রাক্তন ইমাম বায়তুল আল-ফালাহ জামে মসজিদ, হাফেজ মাওলানা যাকারিয়াহ, মৌলভী আওয়াল হোসেন, মাওলানা মো: আরিফুল ইসলাম, হাফেজ মাওলানা মো: মজিবুর রহমান, যাফর ইকবাল, রাজু, মনিরুজ্জামান প্রমুখ এতদসংক্রান্তে বিভিন্নভাবে আমাকে উৎসাহিত ও উপকৃত করেছেন। চূড়ান্ত প্রকাশনার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা ফরিদ উদ্দীন আহমদ, মো: মাসুম বিল্লাহ বিন রেজা, আনোয়ার হোসেন বকুল, মো: আবুল কাসেম, মাহমুদ আলী শাহ, শামীমা আরজু, মাশহুদ আলী শাহ, মামদুদ আলী শাহ প্রমুখ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে যারা এই পর্যায়ে আমাকে এতটুকুও সহায়তা করেছেন। যাঁদের সকলের নামাঙ্কন তুলে ধারা সম্ভব হয়নি। যাঁরা কিছুমাত্র সময় পরামর্শ ও মন:সংযোগকে উপজীব্য করে এই উম্মুন মা-এর প্রকাশনা চূড়ান্ত রূপ লাভ করলো। তাঁদের সবার প্রতি আমার অপরিসীম কৃতজ্ঞতা পেশ করছি।

    বলাবাহুল্য, এই কিতাবের বিষয়বস্তু-বহু গুণিজন, মনীষী, ইমাম, মোহাদ্দেস, বহু গ্রন্থ, দ্বীনি কিতাবাদি পত্র-পত্রিকা থেকে সংগ্রহের ফলশ্রুতি হচ্ছে উম্মুন ‘মা’। নেহায়েৎ না-শুকরী হবে, যদি ঐ সকল গ্রন্থ, কিতাবাদি ও পত্র-পত্রিকার মূল প্রণেতা, অনুবাদক, সংকলক ও সম্পাদকগণের কথা স্মরণ না করি। তাই তাঁদের কাছে আমি বড় মাপের ঋণী। তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যাঁদের জন্য এই প্রয়াস। তাঁরা আকায়ে নামদার খাতামুন্নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শিক সুন্নাহ-ই-আকীদাহকে অবলম্বন করে যদি মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণে সচেতন হোন। তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহর মেহেরবানিতে অবশ্যই সঙ্কটমুক্ত জীবনের ভরসা পাবেন।

    অত:পর সেলায়ে রেহমীজাত রক্ত সম্পর্কীয় আপনজন, আত্মীয়-স্বজন, মেহমান, শিক্ষক-ওস্তাদ, বুজুর্গানে দ্বীন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও আপামর সকলের সাথে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সুন্দর আচরণে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন- তাহলেই দীর্ঘদিনের এই কষ্টকর প্রয়াসে সার্থকতার সন্ধান পাবো। সন্তান কর্তৃক মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ সত্যিই আল্লাহ্ তা‘আলাকে খুশী করে থাকে এবং এ আদব ও আমল তাঁর কাছে বড়ই পছন্দনীয়। মানুষের জীবনের স্বস্তি-নিরাপত্তায় আল্লাহর রহমত লাভেরও কারণ বটে। পক্ষান্তরে তাঁদের প্রতি অসম্মান বেয়াদবিতে আল্লাহ পাকের মেহেরবানি হতে সরে থাকতে হয়-বঞ্চিত হতে হয়। এমনকি তার অন্যথায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আপদ-বিপদ, রোগ-বালাই, দায়-দেনা ও ভাবনা-চিন্তায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে পড়ে। তাই আমাদের সার জন্য সচেতন মনোভাবের প্রয়োজন। আমরা সচেতন হয়ে যাই। -নাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তের আশঙ্কামুক্ত হতে পারবো না। ব্যাপারটা আমরা আমলে নেই না। বুঝতে পারি না। তাই নির্লিপ্ত-নিষ্ক্রিয় থাকি।

    পরিশেষে অনভিজ্ঞতা, জ্ঞানের স্বল্পতা বা অযোগ্যতায় এই গ্রন্থে ভুল-ত্রুটি থাকাটা নিতান্তই স্বাভাবিক। এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী এবং যদি তা সম্মানিত পাঠক সাধারণের কারও নজরে পড়ে অথবা এর কোন অংশের সংযুক্তি বা বিচ্ছিন্নকরণ অথবা কোন হাদীসের উদ্ধৃতি অগোচরে ত্রুটিপূর্ণ হলে অথবা অন্য কোন অংশ অসামঞ্জস্য মনে হলে অধমকে গোচরিভূত করলে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হবো। নিজের ঠিকানাসহ আলোচ্য বিষয়ের সনদ ও প্রমাণপঞ্জিসহ পৃষ্ঠা উল্লেখ করে মেহেদীবাগের ঠিকানায় লিখবেন। তাতে পরবর্তীতে সংশোধনের একটা সুযোগ তৈরি হবে। সবশেষে মহান আল্লাহ জাল্লা-শানুহু আমাদের পরলোকগত মাতা-পিতার আত্মার শান্তি দান করুন। যাদের সম্মুখে মাতা-পিতা উভয়ে বা কোন একজন জীবিত আছেন। তাঁদের অসন্তুষ্টি থেকেও আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাজত করুন। সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদের এই কিতাব হ’তে উপকৃত হ’বার এবং নিজ নিজ মাতা-পিতা ও আত্মীয়বর্গের সাথে সদ্ব্যবহারের তাগিদ অনুভব করুন। সেই সাথে জাযায়ে খায়ের বা উত্তম প্রতিদান প্রাপ্ত হউন। আমীন।

    মুহাম্মাদ মকসুদ আলী

    ১২ই রবিউল আউয়াল, ১৪৩৪ হিঃ

    এক নজরে অধ্যায়ের মূল আদ্যসূচি

    - উপক্রম

    মা-বাবার প্রতি আচরণ প্রসঙ্গে প্রকাশিত জরিপের সারসংক্ষেপ এবং মা-বাবার প্রতি প্রাসঙ্গিক কিছু কথা।

    - মা-বাবার প্রতি পবিত্র কোরআন পাকের আদিষ্ট দর্শনতত্ত্ব।

    - মা-বাবার প্রতি প্রিয় নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীসসমূহের বিশাল ভাণ্ডার থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের দিক নির্দেশনা।

    - পরলোকগত মা-বাবার প্রতি দোয়া-ইস্তেগফার।

    - মা-বাবার সম্মানে আহকামে কদমবুছি।

    - আত্মীয়-আপনজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মর্যাদা।

    - সন্তান-সন্ততির প্রতি মা-বাবা।

    - মা-বাবার বিষয়ে কিছু ঘটনাবলি, সদ্ব্যবহার ও দুর্ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ার কথা। এবং

    - শেষ অধ্যায়ে আল্লাহ পাক-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা, প্রিয়নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি দরূদ ও সালাম এবং সবশেষে মা-বাবার প্রতি দোয়া-ইস্তেগফার ও শেষ বেলার আরজি।

    তাসমিয়াহ

    তাসমিয়াহ ব্যতীত কোন কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। যে পর্যন্ত না, ঐ কাজের শুরুতে তা বলা না হয়। বলেছেন প্রিয়নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই বিসমিল্লাহ শরীফ কোরআন পাকের একটি আয়াতেরও অংশ। এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সর্বকালের জন্য আল্লাহর নামে সকল কাজ শুরু করার নিয়ম প্রবর্তিত হয়। (কুরতুবী ও রূহুল মা‘আনী)। তাই আমরা শুরুতেই পড়ি।

    بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ

    (বিসমিল্লা-হির রাহমা-নির রাহীম)

    অর্থ : পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্ পাকের নামে আরম্ভ করছি। যিনি অতি দয়ালু-অত্যন্ত মেহেরবান।

    প্রথম অধ্যায়

    মহান আল্লাহ্ পাকের প্রশস্তি

    بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ

    পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্ পাকের নামে

    اَلْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ط سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ العَظِيْمِ. وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلى سَيِّدِنَا وَسَنَدِنَا مُحَمَّدٍ وَّ الِه وَاَصْحَابِه اَجْمَعِيْنَ. وَبِحَمْدِه اَسْتَغْفِرُ اللهَ ط رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِىْ صَغِيْرًا.

    অর্থ : সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ্ পাকের, যিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক। মহাপবিত্র আল্লাহ। তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা। আল্লাহ মহামহিম। দরূদ ও সালাম রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও আসহাবগণ সকলের প্রতি। আর যাঁর জন্যই সকল প্রশংসা-আমরা পাপের জন্য তাঁরই কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। হে আমার প্রতিপালক। আমার মাতা-পিতা আমাকে শিশুকালে যেভাবে পরম স্নেহে লালন করেছিলেন। তুমি তাঁদেরকেও সেভাবে অনুগ্রহ কর এবং তোমারই রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দাও।

    মা-বাবার জন্য দোয়া করুন

    প্রথমেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করুন। তাঁর কাছে ক্ষমা ও হিদায়াত কামনা করুন। আমরা যেন নিজেদের দোষ-ত্রুটি বুঝতে পারি ও সুপথপ্রাপ্ত হই।

    আল্লাহ পাক আমাদের সকল সৎকর্মসমূহ কবুল করুন। সেই সাথে দোয়া করুন ঐ মা-বাবার জন্য। জীবদ্দশায় পার্থিব জগতের কষ্ট যেন তাঁদের স্পর্শ না করে। আর কবরবাসী মা-বাবার মাগফিরাতের জন্যেও। তাঁদের রুহ-মুবারকের উপর মহান আল্লাহ পাকের অপার শান্তি বর্ষিত হোক। তিনি অফুরন্ত কল্যাণ দান করুন।

    আর ঐ কবরবাসী মা-বাবার আত্মা, আপনজনের দুয়ারে দুয়ারে পুণ্যির হাদীয়া সংগ্রহের প্রত্যাশায় ঘুরতে থাকেন। জানালার গরাদ ধরে হয়ত তাঁদেরই সন্তানদের মুখপানে চেয়ে থাকেন।

    হায়, আফসোস। অকৃতজ্ঞের মত তাঁদের কথা আমাদের স্মরণ হয় না। আমরা এই পার্থিব জগতের মোহনিদ্রায় অচেতন। এক সময় আমরা তাঁদের উপরই নির্ভরশীল ছিলাম। আমার-আপনার সেই পরলোকগত পরম আত্মারা অপেক্ষা করে করে হয়ত এক সময় তাঁরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে গেছেন। এমনটি না হয়।

    তাঁদের জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করুন। আল্লাহ পাক কল্যাণময়ী। তিনি অবশ্যই কল্যাণ ও রহমত দান করবেন। যারা মা-বাবার সাথে দুর্ব্যবহারে রত-নাফরমান সন্তান। মা-বাবাকে কষ্টে রেখে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাদের থেকে দূরে থাকুন। আর যারা মা-বাবার প্রতি আন্তরিক-খেদমতগুজার সন্তান। আপনি তাঁদের জন্যেও দোয়া করুন।

    মা-বাবা উভয়কে অথবা কোন একজনকে জীবিত পেয়ে আমরা যারা আজো সৌভাগ্যবান। তাঁদের অসন্তুষ্টি থেকেও আল্লাহ পাক আমাদের হেফাজত করুন। আমীন।

    মাতা-পিতার প্রতি আচরণ প্রসঙ্গে প্রকাশিত জরিপের সার-সংক্ষেপ

    কোরআন ও হাদীসের আলোকে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তাঁদের প্রতি সন্তানের আচরণ প্রসঙ্গে একটি ব্যতিক্রমধর্মী জরিপ প্রয়োজন, এই মর্মে গত ১৪-০২-১৯৯৮ইং তারিখে সংবাদপত্রে (দৈনিক দিনকাল) মাতা-পিতার জরিপের উপর এক বর্ণনামূলক প্রশ্নাবলী প্রকাশিত হয়।

    পরবর্তী সময়ে ঐ জরিপের ফলাফল একই পত্রিকায় ২০-০৬-১৯৯৮ইং তারিখে তার সার-সংক্ষেপ ও প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।

    মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের আচরণের উপর বর্তমানে বিরাজমান সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য জানার জন্যই এই উদ্যোগ। এ তথ্যে সত্য প্রকাশের উপর জোর দিয়ে উত্তর প্রদানে বিশেষভাবে অনুরোধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু দু:খের বিষয় তাতে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি। এ থেকেও অনুমিত হয়, মাতা-পিতার প্রতি আমাদের মধ্যে কতখানি সচেতনতার প্রভাব বিদ্যমান। নির্ধারিত সময়কাল অতিক্রমের পর অর্ধশত উত্তরপত্র হাতে এসে পৌঁছায়।

    আজকের সমাজে মাতা-পিতা যতটা নিগৃহীত হ’বার সংবাদ পাওয়া যায়। কয়েক যুগ আগেও তা শোনা যায়নি। যার বিপরীত অবস্থা প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রায় ঘরেই ছোট বড় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা মুসিবতের আবর্তে জড়িয়ে আছে বলে অনুমিত হচ্ছে। স্বস্তি নেই। ঝুট-ঝামেলা নানা সমস্যায় জড়ানো।

    মাতা-পিতার অসন্তুষ্টির কারণে আপদজনক শাস্তির প্রাপ্যতা সন্তানদের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফেও উল্লেখ রয়েছে। মাতা-পিতার সাথে নাফরমানির শাস্তি পরকালের পূর্বে দুনিয়াতেও কিছু আলামত পেয়ে থাকে (তফসীরে মাযহারী)। যা হোক-

    জরিপের প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে যেটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, তা হলো- মাতা-পিতার প্রতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের যত্নশীল বা খেয়ালের অভাব বিদ্যমান। প্রায়শ: অবচেতন মনেরই অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। বলতে গেলে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানদের সচেতনতার পরিবর্তে, এক রকম খেদমতের খেয়ালি অভাব। বিনা চেষ্টায় সাধারণভাবে চলতে থাকা। গতানুগতিকভাবে সম্পাদিত আচরণের মত। গা ছেড়ে দেয়া বেখেয়ালি অর্বাচীন আচরণের দ্বারা মাতা-পিতার সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে কিনা- তারও হিসাব আমরা রাখি না। নীচে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের আচরণ প্রসঙ্গে জরিপের ফলাফল।-

    - অসচেতনতা : মাতা-পিতার প্রতি সন্তানদের যত্ন ও খেয়ালের অভাব (৩৯%)

    - সাধারণত: সাময়িক সচেতন। তেমন দুর্ব্যবহার করা না হলেও সেবার ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল নয়। মা-বাবা সামনের উপর আছেন, করতে হয়-তাই ভাত-কাপড় দিচ্ছেন-এই পর্যন্ত (৩৫%)

    - স্বাভাবিক যত্নশীলতা : নিসঙ্গতা এড়াতে খোঁজ-খবর নেন, কাছে গিয়ে বসেন, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে থাকেন এবং শারীরিক খোঁজ-খবরও নেন। সাধারণ একটা ভাব গৃহস্থ পরিবারে যা হয়ে থাকে (১৭%)

    - উত্তম আচরণ : অতি যত্নশীল সেবা-পরায়ণ, সেবা যত্নের ব্যাপারে বিশেষ ধরনের ধ্যান-ধারণায় যারা সজাগ থাকেন (৮.৩০%)

    - সেবা যত্নে অসীম ধৈর্যশীল : নিবেদিত প্রাণ অতি-উত্তম সেবা-পরায়ণ হিসেবে এক শতাংশেরও কম দেখা যায় (০.৭০%)

    - সবর্মোট ১০০%

    এক কথায় দেখা যায় মাতা-পিতার প্রতি আমাদের সচেতনতার অভাব। কোন মনীষী বলেছেন : অসচেতনতা জ্ঞানহীনতারই শামিল। এ ব্যাপারে ক্ষেত্র বিশেষে অবহেলার কথাও এসে পড়ে। আবার এই অসচেতন আচরণের বিপরীতে ছিটে-ফোঁটা ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। মাতা-পিতার প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবের কয়েকটি চিঠিও হাতে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের কাছে মাতা-পিতাই সর্বপ্রথম এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। মা-ই তার কাছে পার্থিব জগতের সবচাইতে মমতাময়ী সহৃদয় বন্ধু। যারা মা-বাবার সাথে কোমল স্বভাবে মিষ্টি আচরণ প্রদর্শন করে থাকেন। যারা কোমল স্বভাবের সদাচারী ব্যক্তি-আচরণে নম্রতা বিদ্যমান। তাঁদেরকে আল্লাহ পাক বেশী বেশী পছন্দ করেন- ভালবাসেন। মাতা-পিতার অন্তরেও তেমনি অবস্থা থাকা স্বাভাবিক।

    কিছু কিছু পত্রে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। জীবিতকালে দুর্ব্যবহারের বিনিময়ে তারা হয়ত-বা বদলা ভোগ করছেন। একটার পর একটা কষ্টকর ঝামেলার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। তাঁরা বেঁচে থাকতে দুর্ব্যবহারের সকল ক্রিয়াকর্ম স্মরণে আসছে। সময়ে অসন্তোষের পর্যায়ে ধমক বা কু-বাক্যও ব্যবহার করা হয়েছে। তাই আজ এসব মনে হচ্ছে। নইলে এত মুসিবতে কাটবে কেন? অনেকে মা-বাবার বদ-দোয়া লেগেছে বলে দুশ্চিন্তার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু না, মা-বাবারা সন্তানের প্রতি সহজে বদ-দোয়া দিতে পারেন না। নির্যাতন ও অপব্যবহারে অনেক মা-বাবার মনে লাগা কষ্টদায়ক দীর্ঘশ্বাসই তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হ’বার প্রাপ্যতা এনে দেয়। যা হোক-

    জরিপের উত্তরপত্রে এখানে মা-বাবার প্রতি কর্তব্যের অবহেলার কথা লিখেছেন। কেউ কেউ পরিতাপ ও দু:খের সাথে ভোগান্তির কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন।

    কাজেই আমরা যদি নির্বিঘ্ন শান্তিময় একটা পরিবার কামনা করি। তাহলে যেন মাতা-পিতার সাথে নম্রতাসহ সুন্দর ব্যবহার করতে চেষ্টা করি। তাঁদের প্রতি ধৈর্যের সাথে ভক্তি ও শ্রদ্ধাপূর্ণ কর্তব্যে সচেতন হই।

    জরিপের উত্তরপত্রে মায়ের মমত্ববোধ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত কিছু তথ্য এসেছে। মায়ের কাছ থেকে সন্তানরা বাইরে কোথাও গেলে-খবর থাকে না। ফিরতি দর্শন না পাওয়া পর্যন্ত মা বড় উদ্বিগ্ন থাকেন। অতিরিক্ত বিলম্বে, অস্থির হয়ে পড়েন-কষ্টবোধ করেন। বাবা তো কর্মক্ষেত্রে, হয়ত জানেও না। মা দুশ্চিন্তা এড়াতে পারেন না। ওদিকে সন্তানেরা নিশ্চিন্ত। সময়ের ব্যবধানে এক সময় তাঁরাও বুঝতে পারবেন।

    এমনি ধরনের কার্যকলাপে যেন দুখিনী মায়ের কষ্ট না বাড়ে। সুযোগ থাকলে কোনভাবে খবর দিন। সুযোগ না পেলে অন্তত: ঘরে যাবার সুযোগের সন্ধান করুন। অন্তত: মোবাইলে বিলম্বের কারণ জানান। অন্যথা মায়ের কাছে ফিরতে ব্যস্ত হোন। মা জানেন, আপনার দুপুরের মধ্যে এসে একত্রে খাওয়ার কথা। সেখানে সন্ধ্যা গড়ালেও কি দুশ্চিন্তা হয় না? কোন মায়ের হয়ত খাওয়াও হয়নি। একে-ওকে জিজ্ঞাসা করেন-রাস্তাঘাটে কোন অসুবিধা, কোন গোলমাল, পিকেটিং, সংঘর্ষ হয়েছে কিনা? প্রতিবেশী সাথীরা বুঝ দিলেও, মায়ের মন মানে না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে-দায়িত্ব বেড়েছে। একটু-আধটু বিলম্বে অত দুশ্চিন্তা করতে নেই। যাই বলা হোক। ঐসব লঘু দায়িত্বের পাশাপাশি ঘরে অবস্থানরত উদ্বিগ্ন মায়ের প্রতিও আমাদের কিছু ভাবনা হওয়া প্রয়োজন।

    লক্ষ্য করলেই দেখবেন-আপনার আশপাশে অনেক মায়েদের বেলায় এ-ভাব নজরে পড়বে। সন্তানের ফিরতি-বিলম্বে কজন-মা নির্লিপ্ততায় সময় কাটাতে পারেন? যদি আদতেই বাইরে থেকে না ফেরেন। বন্ধুর বাড়ি থেকে যাবার কথাই ভাবেন। বাকি রাত কি মা ঘুমিয়ে কাটাবেন? খবর না পেলে নানা আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তায় মা অশ্রুপাতে ব্যাকুল হয়ে পড়বেন। যদি মা-বাবার মনের অবস্থার কথা জানেন। তবে এমন কাজটি করবেন না। আপনি ইচ্ছে করলেই মায়ের ঐ দুশ্চিন্তা একটু লাঘব করতে পারেন। অন্তত: ফিরতি সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকুন। সংক্ষিপ্তভাবে অন্য কাজ সেরে মায়ের কাছে ফেরার উদ্যোগ নিন। মায়ের কথা ভাবুন। তাতে আশীর্বাদ ও বিপদমুক্ত আশ্রয় পাবেন।

    মেহেদীবাগের নিজ আবাসনের কাছে এক বৃদ্ধা মা ও বাবার অবস্থান। তাঁদের তিন পুত্রধন। বড়টি সংবাদপত্রে কর্মরত অন্যত্র সপরিবারে অবস্থান। বাকি দু’জনের একজন বিজি প্রেসে কর্মরত, ছোটজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্র। ঢাকা থেকে উত্তরখানে ফিরতে যানজটসহ লম্বা সময় লেগে যায়। মাঝে-মধ্যে কোন প্রয়োজনে পড়ুয়া ছেলের ঘরে ফিরতে যখন রাত ক্রমেই বাড়তে থাকে। তখন সাথে সাথে মা-বাবার উদ্বিগ্নতাও বাড়তে থাকে। একান্ত কাছে থাকা অপর ছেলেটিও ওভার-টাইমে জড়িয়ে অনেক সময় রাত-বেরাতে ঘরে ফিরতে হয়। তখন ঐ বৃদ্ধ যুগল যে, কিভাবে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। নানা আশঙ্কায় অনুভূতির প্রাবল্যে অস্থির হয়ে পড়েন। ঘরে টিকে থাকতে পারেন না। বৃদ্ধদ্বয় পথে নেমে পড়েন। কখনো মা-জননী একাই হাঁটতে হাঁটতে অর্ধ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তালতলার কাছে সদর রাস্তায় পৌঁছে যান। এক্ষেত্রে সন্তানরা মায়ের দুশ্চিন্তা এড়াতে কতটুকু সচেষ্ট ভূমিকা রাখেন?

    পরিশেষে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মা-বাবার প্রতি আচরণগত তথ্য সংগ্রহে জরিপের আহ্বানে সাড়া দেয়ায় অনেক কিছু জানা গেল। এ থেকে মা-বাবা প্রসঙ্গে নতুন কিছু তথ্যও অবহিত হয়েছি। যারা জরিপের উত্তরদানে বা অন্যান্যভাবেও সহযোগিতা করেছেন। প্রকৃত অবস্থা বা সত্য উদঘাটনে সদয় হয়ে বিভিন্ন (প্রাসঙ্গিক) তথ্য প্রদান করেছেন। তাঁদের প্রতি এবং বিশেষ করে দৈনিক দিনকাল-এর সদাশয় শ্রদ্ধেয়জন প্রবীণ সাংবাদিক জনাব আখতার-উল-আলম যিনি মাতা-পিতার উপর জরিপের কাজে তথ্য সংগ্রহে অকৃত্রিমভাবে সহযোগিতা দান করেছেন, তার প্রতিও আমার অতিশয় কৃতজ্ঞতা রইল।

    মাতা-পিতা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়

    (১) প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সূচনা

    পবিত্র কোরআনুল করীমে উল্লেখ রয়েছে- তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন, তাঁকে অর্থাৎ আল্লাহ পাক ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না এবং মাতা-পিতার সাথে সুকোমল সদ্ব্যবহার কর। (সূরা বনী ইসরাইল-২৩)

    অনুরূপভাবে আল্লাহ তা’আলা নিজের শোকরের সাথে মাতা-পিতার শোকরকেও একত্রিত করে অপরিহার্য করেছেন। (সূরা লোকমান-১৪)

    অর্থাৎ, আমার শোকরগুজার কর এবং মাতা-পিতারও। এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এবাদতের পর মাতা-পিতার আনুগত্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার ন্যায় মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়াও ওয়াজিব। (কুরতুবী)

    এতদসংক্রান্তে প্রিয় নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এক সহীহ হাদীসেও উল্লেখ রয়েছে : আল্লাহর সন্তুষ্টি মাতা-পিতার সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল। (দুররুল মনসুর)

    এরপর ইতিহাসের পাতায় যে সব মনীষীদের নাম রয়েছে- যাঁরা ওলী, বুযুর্গ, মহাপুরুষ-জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। মাতা-পিতার প্রতি তাঁদের আচরণের দিকটা খুঁজে দেখুন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন আদবী সন্তান। মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই আপনার মাতা-পিতা উভয়ে অথবা কোন একজন জীবিত থাকলে আপনি সৌভাগ্যবান। আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বটবৃক্ষের ছায়ায় প্রশান্তিতে অবস্থানের মত। ভুল করলেও ক্ষমার সুযোগ রয়েছে। আমরা যেন তাঁদের সাথে অকৃতজ্ঞের মত আচরণ না করি। আর তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হই। দোয়া করুন-সন্তানদের থেকেও যেন তার প্রতিক্রিয়ার প্রাপ্যতা না আসে। আল্লাহ পাক তাঁদের অসন্তুষ্টি হতে আমাদের হেফাজত করুন।

    (২) উম্মুন-মা

    আল্লাহ তা‘আলার অপার মহিমায় আমি কার উসিলায় জগতে প্রথম আলো দেখলাম। কার লালিত স্নেহ-যত্নে তিল তিল করে বেড়ে উঠলাম। এ কথা আমি ও আমরা বড় হয়ে অকৃতজ্ঞের মত বেমালুম ভুলে যাই। যখন আমরা মায়ের জঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হলাম। তখনকার কথা কি ভাবা যায়? ঐ মা ছাড়া কারো পক্ষে তা বুঝা সম্ভব নয়। একজন সন্তানের জন্ম মায়ের জন্য জীবন মরণ বিষয়। ঐ সময় যদি মাকে হারাতে হয়। তাহলে শিশুকেও মাতৃহারা এতিম হয়ে নিগৃহীত হতে হয়। প্রসবকালে আঁতুড় ঘরে একেবারেই নিরূপায়-অসহায় নাচার অবস্থা। ঐ অসহায়ত্বের ঝামেলা কে পোহায়? ধৈর্যের সিঁড়ি বেয়ে সহিষ্ণুতার শিখরে দৈনন্দিনের পরিচর্যায় যিনি মমতার সাথে আমাকে লালন করলেন-তিনিই আমার মা-জননী। আমার জনয়িত্রী প্রসবিনী জন্মদায়িনী উম্মুন-মা। ঐ অসহায় শিশুটি মায়ের যত্নে এক সময় একটু একটু করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই একজন শিশুর কাছে আল্লাহ প্রদত্ত জগতের সর্বপ্রথম এবং শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হচ্ছে ‘উম্মুন-মা’। অত:পর আবুন-পিতা

    (৩) শিশুর সর্বোত্তম মাধ্যম

    মাতা-পিতাই শিশুর সব চাইতে বড় মাধ্যম-অবলম্বন। তাঁদের প্রচেষ্টায় ও পরিচর্যায় ঐ শিশুটি নিরাপত্তার সাথে বাড়তে থাকে। কিন্তু এর পেছনে একটা মূল নিয়ন্তা বা চালিকাশক্তি রয়েছে। যিনি সৃষ্টিকর্তা-সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহ। তিনি শিশুর জন্য ঐ মা-বাবাকে পরমজন করে পাঠিয়েছেন। মা-বাবার মধ্যে ত্যাগ-তিতিক্ষার ক্ষমতা দান করেছেন। তন্মধ্যে মা’কে দিয়েছেন মমতাময়ী করে-শিশু লালনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে। ঐ মাকে দিয়েছেন শিশুর জন্য ধৈর্যশক্তি-অসীম সহিষ্ণুতা। জন্মপূর্ব মায়ের সতকর্তা, মায়ের জঠরেই তার অবস্থান। মায়ের কাছেই তার খাদ্যোপকরণ। মায়ের কোলেই তার আশ্রয়ের কেন্দ্র-বিন্দু। সেই মায়ের কোলে ন্যাকড়া জড়ানো তুলতুলে অসহায় নবজাতক শিশু। ঐ সময় অসতর্কতায় কতগুলো লাল পিঁপড়াই তার জীবন হরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু না, মায়ের সচেতনতা-প্রখর দৃষ্টিতে সর্বক্ষণ শিশুর নিরাপত্তা বেষ্টন করে থাকে। ঐ সময় এমন অসহায় যে, কান্নাকাটি ছাড়া নড়াচড়ারও অবস্থা থাকে না। কতই-না সাবধানে সতর্কতায় যত্নে লালন করে যেতে হয় ঐ মা’কে।

    মায়ের পাশাপাশি আল্লাহ পাক পিতাকেও যুক্ত করে দিয়েছেন। জন্মপূর্ব থেকে শিশুর সকল ব্যবস্থা, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ পিতাই যোগান দিয়ে থাকেন। এভাবেই শিশুর জন্মসূত্রে সর্বোত্তম মাধ্যম করে দিয়েছেন মাতা-পিতাকে।

    (৪) মাতা-পিতাই শিশুর মূলশিক্ষক

    মাতা-পিতাই শিশুর পরম শিক্ষাদাতা। তাঁরাই সব চাইতে আপন, প্রথম এবং মূলশিক্ষক। তাঁদের সযত্ন স্নেহ আর আদরে যে শিশুটি বাড়তে থাকে। এক সময় সে চোখ মেলে চারদিকে তাকায়। বাড়তে বাড়তে সে শিশুত্ব কাটিয়ে ওঠে। ঐ সময় থেকেই মা-বাবা লেখাপড়ায় হাতে খড়ি দেন। তাদের সন্তান একদিন মানুষ হবে। তারা অনেক আশা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে অকৃত্রিমভাবে চেষ্টা করতে থাকেন। সে সময় অক্ষর জ্ঞান দিতে কি কষ্টই-না করতে হয়েছে মা-বাবাকে। ব্যঞ্জনবর্ণ দূরের কথা। যার স্বরবর্ণের স্বরেঅ-এর একাংশও জানা ছিল না। একেবারেই অজ্ঞ। এখন ঐসব দিনের কথা এতটুকুও স্মরণ হয় না। স্মরণ করতে পারি না।

    এতদুভয়ের মধ্যে আবার মায়ের ভূমিকাই আগে আসে। পিতাকে রুজির প্রয়োজনে বাইরে থাকতে হয়। শিশুতো সারাক্ষণ মায়ের কাছেই লেগে থাকে। মায়ের কাছে আবদার শিক্ষা-দীক্ষা নিদ্রা সব কিছু। মায়ের কাছেই সব কিছুর পরিচিতি লাভ করে। পিতা এবং ভাই-বোনদেরও চিনতে শেখে। কিন্তু এখানে একটা বিষয় এই যে, মায়ের পরিচয় কাউকে দিতে হয় না। মাকে সে আপনা থেকেই চিনতে পারে। বুঝতে পারে। এও আল্লাহ পাকের হেকমত। অত:পর বালক থেকে কৈশর-বিদ্যালয়ের পাঠ আরো আগেই শুরু হয়। একটু একটু করে তার জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটে। আরও অনেক কিছু জানতে পারে। আস্তে আস্তে মায়ের কোলের ঐ শিশুই, কিশোর থেকে সমাজে মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়। মেধা-মননে নিজেকে বুঝতে পারে। তখন তার কাছে অনুশীলনের মাধ্যমে প্রশ্ন আসে নিজের সম্বন্ধে। কে আমার আপনজন? আমার মা-বাবা? কে আমার সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ইত্যাদি। সে বুঝতে পারে মা-বাবাই আমার সূচনার মূল। তাঁরাই আমার মূল শিক্ষক।

    (৫) একজন পথপ্রদর্শক ও সর্বোত্তম গ্রন্থ

    আল্লাহ পাকের হেকমতে মায়ের কোলের ঐ শিশু এক সময় বড় হয় মানুষে রূপান্তরিত হয়। অত:পর অনুশীলনের মাধ্যমে সে জানতে পারে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। মক্কায় তখন ন্যায়-নীতির বালাই ছিল না। জীবনের মর্যাদা সম্মান ছিল না। চারদিকে শুধু নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছিল। অরাজক জাহিলিয়াত যুগ- মূর্খতার যুগ। পৃথিবীর মধ্যমণি মক্কা নগরীতে ঐ নাজুক পরিবেশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল এক মহামানবের জন্ম হয়। তিনি আলোর দিশারি পথ-প্রদর্শক হয়ে এলেন। তিনিই শেষনবী সাইয়েদুল মুরসালীন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব- প্রিয় নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। যিনি শুদ্ধতায় অনুকরণীয়। যাঁর জীবনের এমন কোন অংশ বা দিক নেই, যেখানে লাল কালির আঁচড় দেয়া যায়। জীবন পথের পরিপক্কতায় ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়তপ্রাপ্ত হন। তখন আল্লাহ পাক তাঁর কাছে দূত মারফত জীবন-ব্যবস্থা মহাগ্রন্থও পাঠালেন। সেই দূত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এসে আল্লাহর বাণী ওহী পাঠ করালেন- পড়ুন-

    اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِىْ خَلَقَ.

    অর্থ: পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে। যিনি বিশ্বলোকের সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা।" (সূরা আলাক : ১)

    ঐ পবিত্র গ্রন্থের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়ালেন। যে গ্রন্থের শিরোনাম আল কোরআনুল কারীম। শিরোনামের নিচে সাধারণত লেখকের নাম থাকে। কিন্তু এখানে তা নেই। সকল গ্রন্থ হতে ব্যতিক্রমী এই গ্রন্থ। এর পাতা উল্টালেই প্রতিটি অক্ষর ও প্রকৃতির পারিপার্শ্বিকতা জানান দেয়। তাতে সর্বক্ষণ সেই মহান সত্তার একক প্রকাশ ও ইঙ্গিত বহন করে চলেছে। তাই মহাগ্রন্থের লেখকের নামোল্লেখের প্রয়োজন হয়নি। তবে সংকলক হিসেবে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম আসে। চলার পথে জীবন ব্যবস্থার সাথে পথ চলার সব রকমের সংকেত এতে রয়েছে। ঐ সংকেত অনুযায়ী শিশু অবস্থা থেকে সবাইকে সবক নেয়া দরকার। এর নির্দেশনায় গুরুত্বসহকারে আল্লাহ পাকের একক সত্তার পরিচয় রয়েছে। এর মধ্যেই রয়েছে মাতা-পিতার প্রতি গুরুত্ব ও আচরণের নির্দেশনা।

    আল্লাহ জাল্লা শানুহু ঐ গ্রন্থে ঘোষণা দিয়েছেন- "আর মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। ...নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতিও। (আল কোরআন-৩১/১৪)

    (৬) মাতা-পিতার প্রতি ঐ গ্রন্থ ও হাদীস শরীফের নির্দেশনা

    ঐ মহাগ্রন্থে সতর্কবাণী রয়েছে। সেই একক সত্তা ও পালন কর্তার নির্দেশনা। যার হাতে আমার-আপনার প্রাণ। তাঁর নির্দেশনায় সকল কিছু তুলে ধরা আছে। সুসংবাদ দু:সংবাদ পুরস্কার তিরস্কার সবই উল্লেখ রয়েছে।

    প্রিয় নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। যাঁদের মাধ্যমে আমার-আপনার আগমন। তাঁদেরকে অর্থাৎ মাতা-পিতাকে যেন অবহেলা করা না হয়। যেন অপমানিত না হতে হয়।

    আধুিনক সমাজের দিকে তাকালে আমরা কোন চিত্র দেখতে পাই? আমরা তাঁদের সাথে কি ধরনের আচরণ করে যাচ্ছি? আমরা আদবী আচরণের কতটুকু মর্ম উপলব্ধি করতে পারি? এতদবিষয়ে মহাগ্রন্থে কি ঘোষণা রয়েছে? আসুন আমরা একটু অনুসন্ধান করে দেখি।এদিকে হাদীস শরীফেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনেক বাণী রয়েছে। সেটাও পড়ে দেখার তাগিদ আসে না। শৈশবে এক সময় আমরা জানার চেষ্টায় কত ব্যাকুল ছিলাম। অজানা নতুন কিছু দেখলেই প্রশ্নবানে মা-বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাম। আর আজ এরই মধ্যে জানার আগ্রহ দমে গেল? আমাদের যেন সব জানা হয়ে গেছে। অথচ প্রিয় নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষাই রয়েছে : দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ কর।

    (৭) আজকের নবীনরাও এক সময়ের মাতা-পিতা

    বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা দুনিয়ার আকর্ষণে ঝুঁকে পড়ি। আয়-রোজগার নিজ সংসার, ঘর-বাড়ি, আরাম-আয়েশে জড়িয়ে যাই। অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত হয় না। যাঁদের মাধ্যমে আমাদের আগমন, তাঁদের প্রতিও মনোযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক পরিবারে গর্ভধারিণী জননী তার যোগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত থাকে। একটু সচেতন হলে বুড়ো বয়সে ঐ বাবাও মনস্তাপে ভুগতো না। এমন পরিবারও আছে, যেখানে মাতা-পিতা সন্তানদের থেকে চরম দুর্ব্যবহার ও নির্যাতন ভোগ করে থাকেন। যারা ছোট থেকে বড় হয়েছে। তরুণ বয়সে পা দিয়েছে। আজকের যারা নবীন। কালচক্রে একদিন তারাও সন্তানের পিতা-মাতা হবে। তখন কি তারাও মা-বাবার বৃদ্ধ বয়সের এই অধ্যায়কে অস্বীকার করতে পারবে? তাই তো কবি বলে গেছেন : ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।

    এক সময় তারাও মাতা-পিতার ঐ আসনে দুর্বল হয়ে পড়বে। কর্মব্যস্ততা হারাবে। বৃদ্ধদের মত শুধু নি:সঙ্গতাই সঙ্গী হবে। অতএব এখনই নবীনরাও নিজের বৃদ্ধ মা-বাবার কথা ভাবতে পারে।

    স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধ মাতা-পিতার বেলায়- যার বাস্তব অবস্থা বড় রূঢ় হয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে বড় মর্মান্তিক হয়ে দেখা দেয়। এ সম্পর্কে পরে আরও কিছু বলার রইল। এর মধ্যে চলাফেরায় যেসব মাতা-পিতা সক্ষম থাকেন। তাঁরা হয়ত একটুখানি মুক্তির স্বাদ পেয়ে থাকেন। কিন্তু বার্ধক্যে শারীরিকভাবে যাঁরা একেবারেই অক্ষম-অচল হয়ে পড়েন। তাঁদের কথা ভাবলেই বুঝা যাবে। সমাজে কত মর্মান্তিকভাবে ঐ সব চিত্র দেখা পড়েছে।

    (৮) অচল মাতা-পিতার অসহায় অবস্থা

    কোন কোন পরিবারে বৃদ্ধাবস্থায় মাতা-পিতার এমন পরিণতি ঘটে, যা আমার পক্ষে ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব নয়। সে অবস্থা বর্ণনা করাও যেন একটা কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঐ সময় পারিবারিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে বৃদ্ধ অচল মা-বাবা বড় বেদনাদায়ক অবস্থায় পড়েন। অচলাবস্থার সাথে সাথে কারো জবানও বন্ধ হয়ে যায়। অথচ সকল অনুভূতিশক্তি বিদ্যমান। সব কিছুই বুঝতে পারেন কিন্তু বলতে পারেন না। তখন তাদের স্মৃতির পাতায় গত হওয়া জীবনটাকে ছবির মত মনে হয়। অনুভূতিশক্তি দিয়ে সব কিছু অনুভব করতে পারেন। পরবর্তীতে আরও সামনের দিকে যে সময়টা আসবে। তখনকার অবস্থা ভাবতে গেলে আরও করুণ। বলতে গেলে কোন বন্ধনই আর থাকবে না। কোন কোন পরিবারে নিজের কোন সন্তানও এই অস্বস্তিকর অবস্থা এড়িয়ে যেতে চায়। এ থেকে অব্যাহতি কামনা করে বসে। পার্থিব জগৎ থেকে তাঁদের চলে যাওয়াকেও উত্তম বলে ভেবে বসেন। মানুষ তো। দীর্ঘদিন ভোগান্তি দেখে দেখে এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক নয়। তবু মা-বাবার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার ব্যাপারটাই জরুরি। এখানে অনুরূপ তিনটি ঘটনা পেশ করছি।

    অবসরপ্রাপ্ত আমারই এক সহকর্মী। অচলাবস্থায় অসহায় নির্বাক, দীর্ঘদিন ধরেই বিছানাগত। অবসর পরবর্তী সময়ে গ্রীন রোড কাঁঠাল বাগানের বাসায় দেখতে গেলাম। ছেলে দেখে চিনতে পারলো। ভাড়া বাসার পূর্বে কোয়াটারে কাছাকাছি অবস্থান ছিল। কিছুক্ষণ পর ছেলে এসে ভেতরে যাবার জন্য আহ্বান করলো। গিয়ে যা দেখলাম-তা করুণ মর্মান্তিক অবস্থা, এমনিতেই চোখ ভিজে আসে। কাঁথা-বালিশ ছাড়া শূন্য তক্তপোষে বড় একটা অয়েলক্লথ পাড়া। বুঝা গেল, ময়লা নোংরার মধ্যে বিবস্ত্র কোঁকড়ানো অবস্থায় তাদের বাবা শুয়ে আছেন। এই মাত্র একটা শুকনো পরিষ্কার লুঙ্গি দিয়ে শরীরটার ওপর ঢেকে দেয়া হয়েছে। অসহনীয় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পিট পিট করে নির্বাক চাহনি। কিছু বলার ক্ষমতা নেই। আল্লাহ পাকের কাছে এহসান কামনা করে ফিরে আসি।

    পাশাপাশি একই অবস্থার দ্বিতীয় ঘটনা-

    ঢাকার সাত রাস্তায় জরিপ অফিসে কর্মরত ছিলেন। আমারই জ্ঞাতি শফিউদ্দিন নামে অবসর পরবর্তী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানাগত। জীবিতকালে কম কথা বলা মানুষটা একেবারেই নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন। মায়ের সাথে সাথে সেবাপরায়ণ ছেলেমেয়েরা দেখা-শোনা করতো। বাড়িশুদ্ধ দাওয়াত বা কোথাও যাবার ব্যাপার ঘটলে-বাবার দেখাশুনার জন্য কারো না কারো থাকার ব্যাপার ঘটতো। এ নিয়ে তখন আলোচনা করা হতো। নিত্যদিন অভ্যাগতরাও দেখা-শোনা করতে আসতো। সময়ে নিজেরও দেখে আসা বাদ যায়নি। বস্ত্রাদি পরিধান অবস্থায় নির্বাক বসা থাকতো। কখানো-বা শয্যাগত দেখতাম। স্বজনদের আসা-যাওয়ায় পরিচ্ছন্ন না রেখেও হয়ত উপায় ছিল না। কে কখন আসা-যাওয়ায় বেহাল অবস্থা দেখতে পায়। তারপরেও বাড়ির মানুষের যদি একটু সচেতনতা-সযত্ন দৃষ্টি না থাকতো। তাহলে হয়ত বৈপরীত্য অবস্থার অবতারণা ঘটতো। বড় ছেলে দেলোয়ারকে দেখা গেছে, মানসিকভাবে সে সর্বক্ষণ সেবাযত্নে সচেতনতার সাথে সক্রিয় ভূমিকা রাখতো। ময়লা নোংরা পরিষ্কারের ব্যাপারেও সে দূরে থাকতো না। কার্যক্ষেত্রে কোথাও গেলে বা বাইরে অবস্থান করলেও, বাড়ির অন্যদের সতর্কতার সাথে বলে যেত। কারণ সে অনুভব করতো-জানতো পীড়িত মানুষের আহাজারি-দীর্ঘশ্বাসও বড় কষ্টদায়ক।

    অপর একটি ঘটনা। আলমডাঙ্গাস্থিত কলেজ পাড়ায় এক পরিবারে অচল বৃদ্ধ মাতা-পিতা। নিজ জ্ঞাতি সম্পর্ক। কাছে থাকা যুবা বয়সের দুই পুত্র, যেভাবে মা ও বাবার খেদমতে রত ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক ভাই তরুণ অধ্যাপক, অপরজন কমপিউটার বিশেষজ্ঞ। সহোদর ভ্রাতৃদ্বয় আপোষে সমঝোতার মাধ্যমে মা-বাবার প্রয়োজনের ব্যাপারে সজাগ থাকতো। বেশী রকমের অচলাবস্থায় ছিলেন মা। ঐ মায়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গোসলের সময় দু-ভাই মিলে ধৈর্যের সাথে পরিচর্যা করতো। অত:পর শিশুর মত খাওয়ার আঞ্জাম করতো। যা নিজেদের শিশু অবস্থায় ঐ-মা তার থেকেও শতগুন বেশী করেছিলেন। তাদের স্মরণে হয়ত সে কথা আসতেও পারে। যা হোক এভাবে বেশ কিছুদিন যাবার পর মায়ের অন্তর্ধান ঘটে। পরবর্তী সময় বাবাও পার্থিব জগৎ থেকে বিদায় নিলেন। জীবিতাবস্থায় ঐ মা-বাবা সম্মুখে বটবৃক্ষের ছায়া বিস্তার করেছিলেন। পরলোকে চলে যাওয়ায় বাড়ির সবাই বড় ভেঙ্গে পড়েছিল। এই যে অবস্থা পরিচর্যা, খেদমত, সহমর্মিতা-এমনটা সকল ঘরে কি হতে পারে না?

    অনেক ক্ষেত্রেই শেষ বয়সের এই অবস্থাগুলো বড়ই মর্মান্তিক-বেদনাদায়ক বলে মনে হয়। আজকের যুগে অনেক পরিবারেই প্রথম ঘটনার মত বৃদ্ধাবস্থায় মাতা-পিতার এমনি বেহাল অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। জরাগ্রস্ত এবং পক্ষাঘাতে শারীরিকভাবে যদি অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন অনেক পরিবারের কাছে, একটা বোঝা বা বাড়তি ঝামেলার মত মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পারিবারিক বোঝা হিসেবে সকলের কাছেই অবহেলিত-অনাদৃত। অবস্থাটা দীর্ঘদিন গড়ালেই অবহেলার ভাবটা প্রকাশ পায়। এটা পরিজনদের আচরণের মধ্য দিয়ে ঐ বৃদ্ধরা বুঝতে পারেন। কিন্তু কিছু বলতে পারেন না। এ আরও মর্মান্তিক। আর্তি প্রকাশের ক্ষমতাটুকুও রহিত হয়ে পড়ে। জবান বন্ধ হয়ে শুধু অসহায় চাহনিটাই টিকে থাকে। ঐ অসহায় হৃদয়হীন পরিবেশ-বৃদ্ধদের জন্য এটাই মর্মস্পর্শী নি:শব্দ আহাজারি। যেখানে বুঝতে পারার মত অনুভূতি শক্তি প্রবল রয়েছে। বেদনাটা সেখানেই দু:সহ হয়ে ওঠে। বলতে না পারলেও অবস্থাটা এমনই দাঁড়ায়- যেন তপ্ত তৈলের কড়াইয়ে পড়ে ছটফট করার মত। অনুভবে-মননে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ এসে যায়-

    "আয় পরোয়ারদেগার আর পারি না, এই পাপিকে তাড়াতাড়ি তুলে নাও।’

    (৯) সময়ের বিবর্তনে বৃদ্ধদের মূল্যায়ন

    একদিন এই বৃদ্ধরাই সমাজের কত প্রয়োজনে জড়িত ছিলেন। অফিস আদালতে হাটে মাঠে কত গুরুত্বপূর্ণ পদে এক সময় কর্মব্যস্ত ছিলেন। অথচ অনাকাক্সিক্ষত এই পরিণতির জন্য আমরা সুস্থ ব্যক্তিরাই অসুবিধা মনে করে থাকি। আসলে বার্ধক্যজনিত এই অবস্থার জন্য তারা নিজেরাই যে কষ্টকর অবস্থার মধ্যে আছেন। অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন। এ ধরনের অবস্থার কথা ভাবিনা-চিন্তাও করি না। বরং ঐ বৃদ্ধদের নিয়ে আমরা অসুবিধার কথা ভাবি। এ অবস্থায় শরীয়াতে সন্তানদের জন্য কি হুকুম রয়েছে। সেটাও বুঝতে পারি না। পাল্টা নিজেদের অসুবিধার কথা ভেবে বসি। নিজেরই বাবা-মায়ের যে কষ্টকর অবস্থা চলছে তা ভাবনায় আসে না।

    প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, চীনা সরকার মা-বাবাসহ বৃদ্ধ-স্বজনদের ব্যাপারে যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হয়েছে। সে দেশের ঐ বৃদ্ধ মা-বাবা স্বজনদের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সাক্ষাৎ ও কুশল নিতে আইন করে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত ২০১২ সালের ২৮শে ডিসেম্বর চীনা পার্লামেন্টে এই আইন অনুমোদন লাভ করেছে।

    (১০) অচল মা-বাবাকে বুড়োবুড়ির ঝামেলা বলে মনে করা

    যেসব পরিবারে মা-বাবা উভয়ে অথবা কোন একজন দীর্ঘদিন অচল হয়ে পড়ে থাকেন। দিনের পর দিন সে পরিবারে একটা বিরক্তিকর অবস্থা দেখা দেয়। ঐ অচল বৃদ্ধ মা-বাবার সাথে ব্যবহারের মধ্যেও ত্রুটি এসে পড়ে। অনেক শিক্ষিত পরিবারেও ঐ অচল বৃদ্ধদের প্রতি অবাঞ্ছিত আচরণ করে বসি। মাতা-পিতার অসহায় অবস্থায় আমারা সন্তানেরা বুড়ো-বুড়ির ঝামেলা বলে মনে করি। তাদের মানসিক অবস্থায় এমনটাই ক্রিয়া করে থাকে।

    আপনজন কেউ এসে কুশল জিজ্ঞাসা করলে, বিরক্তির সাথে জবাব আসে- কি আর করবো, বুড়ো-বুড়ির ঝামেলা বয়ে বেড়াচ্ছি। অচল নির্বাক মা-বাবা কিন্তু পাশের ঘর থেকে সব শুনতে পায়। বুঝতে পারলেও কিছু বলতে পারছে না। কিছু করারও নেই। মা শুধু অনুযোগের সুর তুলে আউ-আউ করে বাবার উদ্দেশ্যে কি সব বলতে শোনা যায়। জবাবে বাবার থেকে কোন আওয়াজ আসে না। শুধু উপরের দিকে দু’হাত তুলে আল্লাহকে ইশারা করে কি বুঝাতে চেষ্টা করেন। হয়ত আল্লাহকে স্মরণ করতে বলেছেন অথবা আল্লাহ আমাদের নিয়ে যাক।

    ঐ পরিবারে একাধিক ভাই-বোন থাকলেও অভিযোগ আসে। বাবা-মা কি আমার একার- আমি একা বয়ে বেড়াবো কেন? সবাই ছ’মাস করে কাছে রাখুক। দু’এক মাস পর পর দরদি হয়ে দেখতে আসার দরকার কি? ওতে বরং ঝামেলা বাড়ে। ভাবির খেদোক্তি শুনে দেখতে আসা দুই ভাই, ভাই বৌয়েরা মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে। এমন ধরনের কথার পরে, হয়ত তারা বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে থাকে। বড় ভাই সচেতন হলে হয়ত বলে বসতো- আব্বা-মায়ের ঝামেলা কাউকে বইতে হবেনা। পারলে তোমরা এসে দেখে যেও।

    বৃদ্ধ বয়সের এই সময়ে, অসমর্থ অবস্থায় তাদের নিয়ে যারা ঐ ধরনের মানসিকতায় ভোগেন। তাদেরকে তীব্র ভাষায় ‘অকৃতজ্ঞ’ বলা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। তারা নামধারী আপনজন আত্মীয় বটে। কিন্তু রক্ত-সম্পর্কীয় সেলায়ে রেহমীজাত দরদি আপনজন নয়।

    (১১) বার্ধক্যে আমাদেরও দম্ভ চূর্ণ হবে

    জন্মদাতা পিতা এবং স্নেহময়ী চির দুখিনী মায়ের অচলাবস্থায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, কাপড় পাল্টানো, ঔষধ পত্রের ব্যবস্থা, নিদ্রা যাওয়া, সাহচর্য দেয়া ইত্যাদি সারতে বিরক্তি ধরিয়ে দেয়। অথচ আমাদের শৈশবপূর্ণ অসহায় কালে আমাদের বিষয়কে আগে দেখেছেন। সংসারে শত কাজের মধ্যেও তাঁরা এতটুকু বিরক্তিবোধ করেননি। এমন অবস্থা তাঁরা পার করে এসেছেন। আর আজ-কালের গতিচক্রে আমাদের কি অবস্থা। ঐ দৈনন্দিনের গু-মূতের নোংরা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেও অপত্যস্নেহে বুকে জড়িয়ে আদর করেছেন। শৈশবে আমরা বার বার বিরক্তিকর কিছু করে বসলেও তাঁরা ঝামেলা বলে মনে করেননি। অথচ লক্ষ্য করুন। আজ তারই বিপরীতে আমাদের চিন্তাধারার প্রতিফলন। আমরা কতখানি অকৃতজ্ঞ সন্তান। একটিবার ভাবুন? ঐ প্রয়াত মা-বাবা চলে যাবার আগে কতটুকু প্রশান্তিবোধ করেছেন?

    ছোট বেলায় এক মুহূর্ত যে মাকে না দেখলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি। আর আজ, তিনিই কিনা বিরক্তিকর বোঝা হয়ে দাঁড়ালো? আমাদের মধ্যে কিসের এত অহমিকা? আমরা কি এ ধরায় চিরকাল রয়ে যাবো? আমারও তো ঐ দশা হবে। নিজেকে দিয়ে অন্তত ঐ অচল মা-বাবার কথা আর একবার ভাবুন। একদিন আপনার-আমার বেলায় যখন ঐ বয়সটা আসবে। তখন তাঁদের মত আমার-আপনার দম্ভও কি চূর্ণ হবে না? নিজেকে নিয়ে ভাবনায় ডুুবে দেখুন।

    (১২) জীবনের শেষ ধাপ

    বৃদ্ধ বয়সটাই জীবনের একটা শেষ ধাপ। সায়াহ্নকাল। জীবনের অনেক স্তর পার হয়ে এই সময়ের আগমন ঘটে। আয়েশে চলাফেরা করার ক্ষমতাটুকুও হারাতে হয়। উঠতে বসতেও কষ্ট পাওয়ার মত অবস্থা দাঁড়ায়। গিটে ব্যথা, বাতের ব্যথা, চলাফেরায় অসুবিধা, উঠতে বসতে কষ্ট। এ সময়টা তাঁদের অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। এই অন্যটা কে, কারা? নিশ্চয়ই সন্তানাদি ছাড়া আর কারো হওয়ার কথা নয়। ঐ সময় ঐ বৃদ্ধ মা-বাবার শারীরিক দিক দিয়েও অনেক বাধা-বিপত্তি আসে। সেসব অসুবিধা ভুক্তভোগীরা ছাড়া অন্যেরা কি করে বুঝবে? অন্যেরা সাধারণভাবে বুঝতে পারে তার কষ্ট হচ্ছে। সে কষ্টের অনুভূতি কেমন, তা অন্যের পক্ষে বুঝা দুষ্কর। তিনি বলার পরেও অনেক সময় সব কষ্টের কথা বলা সম্ভব হয় না। বলতে পারেন না। তিনি জানেন, বললে আশাব্যঞ্জক সাড়া নাও আসতে পারে। তাই হয়ত তিনি বলেনও না।

    শুনে কোন ছেলে বা ছেলে-বৌ বলেই বসে- শেষ বয়সে অমন একটু-আধটু অসুবিধা হয়েই থাকে। কিভাবে কি করলে একটু আরাম বা আয়েশ যাপন করতে পারেন। সে চেষ্টা না করে বরং অমন কথায় আরও একটু মর্মযাতনা বেড়ে যায়। বুঝলাম, কথাটা একেবারেই বাস্তব সত্য। তাই বলে অমন করে নীরসভাবে বলা কি ঠিক হয়? কেমন অপ্রিয় শোনা যায় না?

    এছাড়াও কথা শোনা যায় অন্ত:পুর থেকে বলে বসে। বসে বসে খাওয়ার জন্যেও চোখ টাটায়। ছোট ছেলে বা মেয়েটাকে ঠিকমত স্কুলে দিয়ে আসতে পারে না। বাজারটাও করে খেতে পারে না ইত্যাদি।

    আস্তে আস্তে জীবনের একটা শেষ বিন্দুতে এসে দাঁড়াবে। সে বিন্দুতে একসময় আমাদেরও পৌঁছাতে হবে। তাই বাবা-মা বার্ধক্য এবং অচল হয়ে যাবার পূর্বেই, সময় থাকতে সচেতন হয়ে যাই। সময়টা সকলের জন্যই এসে উপস্থিত হবে। অত:পর মৃত্যু অবধার্য। তাইতো চিন্তাশীল মনীষী কোরআন পাকের সূরা আন নিসার ৭৮ আয়াতের বরাতে কবিতার ছন্দে বলে গেছেন:

    যেখানেই তুমি থাক না কেন

    যতো হও সাবধান,

    মৃত্যু তোমারে কেড়ে নেবে ঠিক

    পাবে না পরিত্রাণ।

    اَيْنَ مَا تَكُوْنُوْا يُدْرِكْكُّمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِىْ بُرُوْجٍ مُّشَيِّدَةٍ.

    অর্থ : তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই- যদি তোমরা সূদৃঢ় দুর্গের ভেতরে অবস্থান কর, তবুও। (সূরা আন-নিসা : ৭৮)

    (১৩) বৃদ্ধদের জন্য পৃথক আশ্রয় কেন্দ্র

    বৃদ্ধ বয়সে ঐসব মাতা-পিতা বা দাদা-দাদির জন্য বিদেশে পৃথক বৃদ্ধ নিবাস-আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা রয়েছে। ঐ সকল আশ্রয়কেন্দ্রের বা সেবালয়গুলো বেশিরভাগ সরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও কিছু দরদি বিজ্ঞজনের প্রচেষ্টায় সরকার অনুমোদিত বেসরকারি উদ্যোগে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আমার এক ভাই গাজীপুরের মণিপুরে বিশাল এক বৃদ্ধাশ্রম গড়েছেন। তিনি পাবনা জেলার শ্রীপুর গ্রামের অধিবাসী। বর্তমানে গিভেন্সী গ্র"প অব ইন্ডাষ্ট্রিজ-এর চেয়ারম্যান ও এমডি আব্দুল জাহিদ। গাজীপুরের ঐ বৃদ্ধাশ্রমের খতীব মুকুল ভাই নামে পরিচিত। তিনি বৃদ্ধ মা-বাবাদের যে কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রতি আস্সালাম ও আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। ঐ গুণি দরদি মানুষটার অনুপ্রেরণা হচ্ছে শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা। মুকুল ভাই তাঁকে মা সম্বোধন করে ডাকতেন। তাঁকে দিয়েই কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন। আর তিনিও (মাদার তেরেসা) মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

    বেশ কিছুদিন আগে সংবাদ পত্রের এক বিজ্ঞাপনে অপর এক বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়ে উল্লেখ ছিল- বৃদ্ধদের সেবায় বাংলাদেশে আমরাই প্রথম। বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে আর ভাবনা নয়। আপনাদের কিছু করতে হবে না। তাঁদের সেবায় আমরা নিয়োজিত। আমরাই তাঁদের নি:সঙ্গতা দূর করে, সুস্থ সজীব আনন্দমুখর রাখার উদ্যোগ নিয়েছি ইত্যাদি।

    অর্থাৎ যেসব আর্তপীড়িত দু:স্থ অসহায় বৃদ্ধ মাতা-পিতা রয়েছেন। আত্মীয় পরিজন যাদের কেউ নেই। অথবা থেকেও না থাকার অবস্থায় সকল দিক থেকে বঞ্চিত। হতাশা বিদ্ধের মত সময় যাপন করছেন। তাঁদের জন্যই এ বৃদ্ধাশ্রম হচ্ছে পরম ভরসাস্থল। সমাজে ঐ ধরনের আশ্রয়স্থলেরও প্রয়োজন রয়েছে। গাজীপুরের মত নারায়ণগঞ্জ এবং আগারগাঁও এলাকাতেও বৃদ্ধ নিবাস গড়ে উঠেছে। ঐ বৃদ্ধ নিবাসগুলোতে উপযুক্ত স্বাচ্ছন্দ্যতা না থাকলেও আরও নান্দনিক এবং অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধার চেষ্টা চলছে।

    বিগত কয়েক বছর আগে দৈনিক জনকণ্ঠের এক সাক্ষাৎকার নিবন্ধে সমাজ সেবিকা রীনা রহমান নাম্নী ‘সহায়ক’-এর মাধ্যমে এমনি এক বৃদ্ধনিবাস গড়ে তুলেছেন আগারগাঁওয়ে। তিনি ঐ দৈনিকে সাক্ষাৎকার নিবন্ধে বৃদ্ধাদের সেবার প্রশ্নে স্বীয় পিতার দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছেন। রুগ্ন মায়ের সেবায় হতাশা ছাড়া আর কোন আশা দিতে পারেননি। একইভাবে ভিন্নরূপে নিজ শ্বশুরের অবস্থাও তাই দাঁড়ায়। শাশুড়িকে পাননি। তার একান্ত আপন এই ঘনিষ্ঠ তিনজনকেই বড় করুণভাবে হারাতে হয়েছে।

    রীনা রহমান নিজের পরিবারেই এই তিন আপনজন থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অসহায়ত্ব অনুভব করেন। পিতৃ ও মাতৃসেবী রীনা রহমান এভাবেই ঐ অসহায়দের খেদমতে এগিয়ে আসেন। তেমনি ঐ আগারগাঁও-এ দরদি প্রাণ ডা. আবদুল ওয়াহেদ সাহেব (প্রয়াত) প্রবীন ভবন নামে অপর একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়েছেন। সেখানে প্রায় অর্ধশত অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবার ঠাঁই হয়েছে। এই প্রবীন ভবন বর্তমানে কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। যার সভাপতি জনাব নজরুল ইসলাম। সেক্রেটারী আতিকুর রহমান। ট্রেজারার আবুল বাসার ও আরও কিছু হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি রয়েছেন। তবে খুশীর বিষয় সরকার থেকে তারা বেশ কিছু অনুদানও পাচ্ছেন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রবীন হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান নামে একটা গবেষণা কার্যক্রমও চালু করেছেন। এর মাধ্যমে একটা প্রবীন হাসপাতালও গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এমনি ধরনের গাজীপুরেও মহতী প্রাণ মুকুল ভাই বিশাল এক বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলেন। তিনি ছোট বেলা থেকেই মা-বাবা ও বৃদ্ধদের প্রতি মমত্ববোধ ও সহনশীল ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছের। আল্লাহ পাক তাঁকে সফলতা দান করুন।

    (১৪) বৃদ্ধনিবাসে আশ্রয় নেয়া

    যে সব সন্তানেরা তার বৃদ্ধ মাতা-পিতার খেদমতের ব্যাপারে অপারগ। দেখাশুনার সুযোগ করে উঠতে পারে না। নিজের পরিবারেও সময়ের অভাব। তাদেরকেই বৃদ্ধ মা-বাবার খেদমতের ভার অন্যের হাওলায় তুলে দেয়ার জন্যই ঐ বৃদ্ধ নিবাসের আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু এমন অবস্থা হওয়াটা কি সঙ্গত ছিল? পদে পদে যাদের প্রতি, প্রতিদান দিতে সুযোগ খোঁজার কথা। সেখানে আপন জনক-জননীর খেদমতের সুযোগ নিজে হাতে করতে না পারাটা গর্হিত কাজের অন্তর্ভুক্ত বৈকি? পরমজনের খেদমতে সন্তানদের অক্ষমতারই নামান্তর। অথচ নিজ হাতে তাদের খেদমতের সুযোগ পেয়ে ধন্য হওয়ার কথা।

    পারিবারিক জটিলতায় যারা মোটেও খেদমত করতে পারেন না। যুক্তিসঙ্গত কারণ বিদ্যমান। এমন সংখ্যা খুব কমই পাওয়া যাবে। যারা নি:সহায়, তিন কুলে সহায়ক বলতে কেউ নেই।তাঁরাই ঐসব বৃদ্ধনিবাসে অবস্থানের একমাত্র হকদার। তেমন অবস্থায় খোঁজ পেলে সন্ধান দেয়াটা বরং খেদমতের শামিল হবে। আমাদের দেশে একনো সরকারি পর্যায়ে এ জাতীয় পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধ নিবাস বা ওল্ড হোম গড়ে উঠেনি।

    (১৫) বৃদ্ধনিবাসে ভাল-মন্দের দু’টি দিক

    প্রথমত: ভালোর দিকটা তুলে ধরতে গেলে আমরা দেখতে পাই। যে সব পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবা অযত্ন-অবহেলায় সময় কাটে। অথবা যারা নিগৃহীত নিত্য যাতনা ভোগ করে থাকেন। অথবা যারা ক্ষুধার্ত থাকেন, পরিবারে ক্ষুন্নিবৃত্তির অভাব। অথবা যার কেউ নেই। নি:সঙ্গতায় ভোগেন। তাঁরা সেখানে গেলে অবশ্যই যাতনাহীন কল্যাণকর অবস্থায় দিন যাপন করতে পারবেন। আর তাঁরা সেখানে স্বস্তিবোধ করে তৃপ্ত হবেন।

    (১৬) সেখানে মন্দ বা কষ্টের দিক

    যাদের বয়স ভারী হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকে নিজেরাই বুঝতে পারেন। আমরা আস্তে আস্তে বুড়িয়ে যাচ্ছি। অচল হয়ে পড়েছি। আমরা এখন হতশ্রদ্ধ। ছেলেমেয়েদের সংসারে অপাংক্তেয়, বর্জনীয়, একঘরে হয়ে থাকার মত। যাদের আত্মীয়-পরিজন, নাতি-নাতনি, সেলায়ে রেহমীজাত সম্পর্কের সবাই রয়েছে। তাঁদের বেলায় যদি মানুষের সব চাইতে গুরুত্ব ঐ আপনজনদের খেদমতের দায়ভার এড়াতে ঐ নিবাসে আশ্রয় নিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়। যদি বলা হয় এখানে অর্থাৎ বাসায় আপনাদের কে দেখাশুনা করবে? ছেলেমেয়ে সারাদিনের মত কলেজে যায়। নিজেকে অফিস করতে হয় ঐ সময়টা আপনাদের দেখাশুনার অভাব ঘটে। না হয়, সপ্তাহে ছুটির দিনে ওদের নিয়ে দেখা করে আসবো। এভাবে অবধারিত প্রতিপন্নের মত বলে তাঁদেরকে বুঝ দেয়া হয়। ঐ সব বুঝ দিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যগতভাবে যদি তাদের সেখানে রেখে আসা হয়। তাহলে মানসিক যাতনা ভোগের সীমা থাকবে না। গ্রাম-গঞ্জে যেমন গরু-ছাগল ফসল খেলে, ক্ষেত মাড়ালে, খোয়াড়ে রেখে আসা হয়। বৃদ্ধ মা-বাবারও তেমন অবস্থা দাঁড়াবে। নিজেদেরকে অবরুদ্ধতায় বন্দিদশার মত মনে হবে। এমনকি বৃদ্ধদের সঙ্গের সাথী প্রত্যাশিত ভালবাসার ধন নাতি-নাতনিদের সাথেও সপ্তাহ অন্তর দর্শন দানেও সময়ের অভাব ঘটে বসবে। তখন আর আগের দেয়া প্রতিশ্রুতির কথাও স্মরণ হয় না। বলা হয়েছিল সপ্তাহে সপ্তাহে ছুটির দিনে দেখা করে যাবে।

    এক সময় ছোট ছেলেটার সাথেও কলেজ আর ক্লাসের চাপে দেখা হয় না। দেখার ইচ্ছায় মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন থাকেন। তাঁদের এই মন:পীড়া ক্ষুধার জন্য নয় শরীরের কোন ব্যথার জন্যও নয়। এই মন:পীড়া আপনজনের দর্শনের জন্য-বিরহিতের জন্য। সেটাই বড় হয়ে ব্যথার মত অন্তরে গিয়ে পৌঁছেছে।

    এরপর পাশ্চাত্যের সভ্য সমাজে মানুষের সব চাইতে বরেণ্য আপনজন শ্রদ্ধেয়জন ঐ মা-বাবাকে ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয়। তারাও জানে যে, ছেলেমেয়ের সংসারে আমরা এখন গ্রহণযোগ্য নয়-বর্জনীয় বিষয়ের মধ্যে গণ্য। সেজন্য পাশ্চাত্যের অনেক সচেতন বৃদ্ধরা সময় থাকতে বাকি জীবন কাটাতে কেউ কেউ নিজেরাও গিয়ে সেখানে উঠেন। তাদের এই যাওয়াটা পরিতৃপ্তির নয়, বরং কষ্টের।

    (১৭) মা-দিবস বাবা-দিবসের তাৎপর্য

    জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃত ও অনুমোদন সাপেক্ষে ঐ দিবস পালিত হয়ে থাকে। সম্প্রতিকালের কয়েক বছর বেশ জাঁকজমকের সাথে মা-দিবস, বাবা-দিবস পালন করতে দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা-দিবস ও জুন মাসের ৩য় রবিবার বাবা-দিবস। বছরের ঐ দিবসে ঘটা করে ভালমন্দ রান্না করে খাওয়ানোর চেষ্টা

    Enjoying the preview?
    Page 1 of 1