Discover millions of ebooks, audiobooks, and so much more with a free trial

Only $11.99/month after trial. Cancel anytime.

আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali)
আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali)
আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali)
Ebook498 pages3 hours

আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali)

Rating: 0 out of 5 stars

()

Read preview

About this ebook

প্রতিটি নর-নারী সবল অথবা দুর্বল যা-ই হোক তার পৃথিবীর আগমন একই প্রক্রিয়ায় আবার ঠিক তেমনই আরাম আয়েশ অথবা অবহেলা অনাদরে প্রস্থান এই চিরন্তন রীতির কোনো পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা আজও পর্যন্ত কেউ অর্জন করতে পারেনি। তাই সৃষ্টির গোড়া থেকেই দু’টি শ্রেণী এই পৃথিবীর বিচরণ ক্ষেত্রে প্রবাহমান। ক্ষুদ্র সংখ্যাটি অত্যন্ত প্রবল, বৃহত্তর অংশটি দারুণ দুর্বল। স্রষ্টার এই রহস্যময় সৃষ্টির কি কারণ? একটি মাত্রই কারণ সৃষ্টিকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখে দাঁড় করানো। একে অন্যের প্রতি যে অধিকার রয়েছে তা পুরোপুরি আদায় করাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত। কিন্তু সবল সব সময় তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে দুর্বলকে শোষণ নির্যাতন করে মানবতার মৃত্যু ঘটিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করে রাখে। বিশেষ করে গরিব দেশগুলোর ক্ষুধার্ত মানুষকে পুঁজি করে ধনী দেশগুলো দারিদ্র্য বিমোচনের নামে সুশীল সমাজ নামের একদল দালাল সৃষ্টি করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা মহাজনী ব্যবসা ভিন্ন নামে ভিন্ন কৌশলে শোষণের মাত্রা একই মাপকাঠিতে চালানো হচ্ছে। পৃথিবীর শত সহস্র সৃষ্টি কেবলমাত্র মানুষের কল্যাণের জন্য প্রতি নিয়ত প্রথানুযায়ী নিজেকে সোপর্দ করে দিতে সদা তৎপর। আর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি অবিচার, শোষণ নিপীড়ন করতে তাদের আত্মা এতটুকু আলোড়িত হয় না। এই সবল মানুষের কালো হাত গুড়িয়ে দিতে দুর্বলের নতজানু ভূমিকা ত্যাগ করে ধৈর্য, সাহস ও কর্মদক্ষতা সৃষ্টির মধ্যে তা সম্ভব। এর জন্য হতে হবে একতাবদ্ধ আর সামান্য সংখ্যক হলেও একদল আদর্শবাদী জ্ঞানীগুণী, ত্যাগী মানবপ্রেমিক। যারা এই সব দুর্বল অসহায়দের ঝাপসা চোখে ঘুটিয়ে তুলবে আশার আলো। সমাজে এমন ত্যাগী মানুষেরও অভাব নেই। হতাশা আর দুর্বলতা সৃষ্টির জড়তা কাটিয়ে তারা যদি এই আলোময় পৃথিবীর বুকে দুর্বলদের শান্তির নীড় রচনা করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে শোষকের হাত নিস্তব্ধ হয়ে যাবে, অন্ধকার দূর হয়ে আলোয় ভরে যাবে এই বিশ্ব। তারই একটা চিত্র এই সামাজিক উপন্যাসখানিতে দেখানো হয়েছে।

LanguageBengali
Release dateMay 2, 2015
ISBN9781310561986
আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali)

Read more from বজলুর রহমান Bazlur Rahman

Related to আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali)

Reviews for আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali)

Rating: 0 out of 5 stars
0 ratings

0 ratings0 reviews

What did you think?

Tap to rate

Review must be at least 10 words

    Book preview

    আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali) - বজলুর রহমান Bazlur Rahman

    তোহফা

    পল্লী কবি জসীম উদ্দীন

    স্মরণে-

    এক

    শহর থেকে অনেক দূরে প্রকৃতি পরিশোভিতা একটি রমণীয় গ্রাম আলোকদিয়া। এমন সুন্দর একটি নাম কত বছর আগে কে দিয়েছিলো তা পাওয়া যায় না। সেই সময় এই নামের সাথে গ্রামের মানুষের হৃদয় আলোকিত ছিলো কিনা তা কেউ বলতে পারে না। গ্রামের দক্ষিণ পূর্ব দুই দিকে সমতল কৃষিভূমি, উত্তর পাশে মস্তবড় একটা জলাভূমি যার নাম আলোকবিল। পশ্চিম দিকে গ্রামের গা ঘেঁষে একটি বড় কাঁচা রাস্তা উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। রাস্তার পশ্চিম পাশে গ্রাম। বহুদিনের পরিত্যক্ত একটি কাচারী বাড়ি। তারপরেই কমলাপুর গ্রাম।

    বড় রাস্তা থেকে একটি ছোট মেঠো রাস্তা এঁকে বেঁকে পূর্ব পশ্চিমে দুই গ্রামের সাথে মিশে গেছে। পূর্ব দিকে যে কোণের সৃষ্টি করেছে ঠিক তার মাথায় একটা বড় বট গাছ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তার ডালপালা ছড়িয়ে দিয়ে কত যুগ দাঁড়িয়ে আছে তারও কোনো হিসাব নেই। তারই নিবিড় ছায়ায় একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।

    যখন স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিলো তখন গাছ থেকে অনেক দূরত্ব রেখে করা হলেও পরবর্তীতে বৃক্ষরাজ কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেদিকে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সবুজ পত্রপল্লবে ছেয়ে এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। স্কুলের সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের খেলার মাঠ। কমলাপুর গ্রামে কোনো স্কুল নেই। তাই ঐ গ্রামের ছেলে-মেয়েরা মাঠ পেরিয়ে আলোকদিয়া প্রাইমারী স্কুলে পড়তে আসে। রোদ বর্ষা মাথায় করে তাদের আসতে হয়। একান্ত যাদের শিক্ষার প্রতি আন্তরিক টান আছে তারা বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভালবেসে তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠায়। আর সেইসব ছেলে-মেয়ে অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিদের। গরিবেরা তাদের ছেলে-মেয়েদের জুতা, ভাল জামা কাপড় দিতে পারে না বলেই জোর করে ঠেলেঠুলে স্কুলে পাঠায় না। তবু কিছু ছেলে-মেয়ে তাদের বাবা মা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দিতে না পারলেও প্রতিবেশী একান্ত খেলার সাথীদের সাথে স্কুলে আসে। কেবল স্কুল সূত্রেই নয় এক মাঠে চাষবাস আবার উভয় গ্রামের জনমজুরদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ কারবার সব শ্রেণীর মানুষের মাঝে একটা যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছে। আরও একটি বড় কারণ বছরের দুই পবিত্র ঈদের নামায দুই গ্রামের মানুষ মিলিতভাবে এই বটতলায় আদায় করে। অনেক বছর আগে বটবৃক্ষের উত্তরাংশের বেশ কিছু এলাকা ঈদগাহ হিসেবে দান করেছেন আলোকদিয়া গ্রামের আবুল আসাদ খানের দাদী। প্রাইমারী স্কুলের জায়গাটাও একদিন খানদের ছিলো। তার দাদা পূর্ব দেশীয় একজন মৌলভী রেখে এখানে একটি পাঠশালা খুলেছিলেন। তখনই তিনি এক একর জমি পাঠশালায় দানপত্র লিখে দিয়ে যান। পরবর্তীতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপ নেয়।

    ইদানিং দুই গ্রামের মানুষ মিলে বট গাছের দক্ষিণাংশে স্কুলের পেছনে সপ্তাহে দু’দিনের জন্য বাজার বসিয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে রাস্তার কোল ঘেঁষে একটা ওয়াক্তিয়া মসজিদ তৈরী করা হয়েছে। বাজারে বিক্রেতাদের কাছ থেকে সামান্য খাজনা নেয়া হয়। সেই অর্থ দিয়েই মসজিদের খরচ চলে যায়। আবার ঐ বাজারকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটা পাল্কী দোকানও আশে পাশে বসে গেছে। স্কুলের সভাপতি আবুল আসাদ খানের হাতে পায়ে ধরে কাজিম শেখ বিদ্যালয়ের পশ্চিম উত্তর কোণে বট গাছের ছায়ায় একটি ছোট্ট পাল্কির দোকান তুলেছে। সেই দোকানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার দশ বছরের ছেলে শহীদ বেচাকেনা করে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা তার দোকানের খরিদ্দার। খাতা কলম, চকলেট, বিস্কুট থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীদের যা প্রয়োজন তা সব ঐ দোকানে পাওয়া যায়। অল্প টাকার মালামাল হলেও সংখ্যা অনেক। স্কুলের শিক্ষকরাও প্রতিদিন এটা ওটা নিয়ে থাকেন। পাশের বড় রাস্তা দিয়ে যারা যাওয়া আসা করে তারা ক্লান্তি দূর করার জন্য তার দোকানের সামনে পেতে রাখা বাঁশের চটার বেঞ্চিতে বসে যায়। তারাও কিছু না কিছু কেনাকাটা করে।

    শহীদ ছেলেটা অল্প বয়স্ক হলেও তার কথাবার্তা, আচার ব্যবহার সবকিছুতে একটা অলঙ্কার আছে। অশিক্ষিত গরিব ঘরের ছেলে বলে মনেই হয় না। খুব পরিষ্কার চেহারা, বয়স অনুপাতে সুন্দর স্বাস্থ্য মুখে সদা হাসি প্রত্যেকেরই মন কেড়ে নেয়। সেখানে আরো কয়েকটি দোকান থাকলেও তার দোকানেই খরিদ্দার বেশী। বেচাকেনা হয় ভাল। স্কুলে তারই বয়সের ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বেশী। তাদের সাথে ওর খুব ভাব। তার ইচ্ছা হয় ওদের সাথে মিলেমিশে স্কুলে পড়া লেখা করা, খেলাধুলা করা। কিন্তু মনে করলেই তো আর সম্ভব হয় না। তার বাবা মাঠে-ঘাটে গৃহস্থের কাজ করে। সে বুঝে আব্বার খুব কষ্ট হয়। সে তার মায়ের কাছে শুনেছে তার আব্বা জীবনে মাঠের কাজ করেনি বরং জনমজুর খাটিয়ে কাজ করতেন। তার মা এর বেশী বলে না, সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে যখন জানতে চায় সেইসব ফেলে আমরা চলে এলাম কেন? ওর মা তখন আঁচলে মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলে কোনো কথা বলতে পারে না। অল্প বয়স্ক এই গভীর বুদ্ধির বালকটি তখন বুঝে নেয় তার মা বাপের অন্তরে একটা কষ্টদায়ক বেদনা লুকিয়ে আছে, সেখানে হাত দিলেই তারা ব্যথা পান। তারও মনে পড়ে দু’বছর আগের কথা। তাদের ঘর বাড়ি, পুকুর, ফলের বাগান, গরু বাছুর আরও কত কি ছিলো। সে গ্রামের স্কুলে পড়তো। তার পড়ার সাথীদের সাথে হৈ হুল্লা করতে করতে স্কুলে যেত! বাড়ি এসে তাদের সাথে খেলাধুলায় মেতে থাকতো।

    সন্ধ্যা হলেই তার চাচাতো ভাই বোনদের সাথে পড়তে বসতো। সে কেবল ক্লাস থ্রিতে উঠেছে এমনই সময় কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল। একদিন রাতের বেলা বোচকা বুচকি বেঁধে বাবা মা তাদের নিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে পথে বেরিয়ে পড়লেন।

    বড় হলে একদিন নিশ্চয় সে এর কারণ জানতে পারবে- এমন আশা সে রাখে। তার বাবা মা তাদের তিন ভাই-বোনদের খুব ভালবাসেন। সে বড়, মেজটি বোন আর ছোট ১টি ভাই। বাবা মা খেয়ে না খেয়ে তাদের খাওয়ায়, পরের বাড়ি কাজ করতে দেবে না তাই কিভাবে সে জানে না তার আব্বা এই দোকানটি করে দিয়েছেন। এতদিন সে সব সময় মনমরা হয়ে থাকত, কারও সাথে মিশতে পারত না। তার খেলার সাথীদের সে ফেলে এসেছে। এখানে সব নতুন। তার বয়সের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যায়, সে যেতে পারে না তাই কেউ যেন তার সাথে মিশতে চায় না। এবার তার নি:সঙ্গতা দূর হয়েছে। স্কুলে পড়তে না পারলেও ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকদের সাথে সারাক্ষণ দেখা হচ্ছে- কথা হচ্ছে আবার বেচাকেনার মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। এখন বাড়িতে তার একটুও মন টেকে না। রাতটা পার হলেই হয়। দু’টো নাকে মুখে গুজে দোকানের দিকে দৌড় দেয়। তার ইচ্ছা স্কুলে ছেলে-মেয়েরা আসার আগেই সে দোকান খুলবে। সে জানে ন’টায় ক্লাস বসলেও ওয়ান-টু’র ছেলে-মেয়েরা সকাল সাতটার মধ্যে এসে কিচির মিচির করে। তারাই তার প্রতিদিনকার বাঁধা খরিদ্দার। হয় একটি কেক না হয় একটি পাউরুটি নতুবা বিস্কুট চকলেট। একটা না একটা কিছু তারা নেবেই। পল্লী অঞ্চলে গৃহিণীদের সকালেই সংসারের কাজ বেশী। তাই ছেলে-মেয়েরা যাতে ঝামেলা করতে না পারে, যার হাতে যেমন থাকে টাকা আধুলি তাদের হাতে গুজে দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়।

    শহীদের সাথে তাদের সম্পর্ক এতো গভীর হয়ে গেছে দৈবৎ তার যদি আসতে দেরীও হয় তবু তারা অন্য দোকানে না যেয়ে ওর অপেক্ষায় বসে থাকে। বিক্রি বেশী অথচ পয়সা কম তবু তাতে তার লাভ বেশী। সে বুঝেছে বেশী পয়সার মালে লাভ কম। তাই সেসব মাল কম রেখে অল্পমূল্যের মাল বেশী করে রাখে। প্রতি শুক্রবার স্কুল বন্ধ থাকে, সেই দিন সে তার আব্বার সাথে দূরের বড় বাজার থেকে মালামাল নিয়ে আসে। পাইকারী দোকানদার শহীদের বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে অনেক টাকার মাল বাকীতে দেন। তাই শহীদের ছোট্ট দোকানটি সব সময় মালামালে পূর্ণ থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে সচরাচর যা দরকার হয় তা সব শহীদের দোকানে পাওয়া যায় বলে গ্রামের বৌ ঝি’রা তাদের স্বামীদের জ্বালাতন না করে ছেলে-মেয়েদের দিয়ে আনিয়ে নেয়। এতে বাড়তি যাওয়া আসা করতে হয় না। স্কুলে আসার সময় তাদের হাতে পয়সা দিয়ে বলে দিলেই হলো, ছুটির পর তারা তা কিনে নিয়ে আসবে। অনেকের হয়ত স্কুলে যাওয়ার মতো ছেলে-মেয়ে নেই, তাতে কি! পাড়ার যে কোনো ছেলে-মেয়ের হাতে পয়সা দিলেই এসে যাবে। এরও একটা কারণ আছে। শহীদ খুব বুদ্ধিমান ছেলে। সে খেয়াল রাখে যেসব ছেলে-মেয়েরা তার দোকানে কেনাকাটা করে অন্তত: একটা করে চকলেট বিনামূল্যে দিয়ে তাদের ভুলিয়ে রাখে। স্বল্পবুদ্ধির বালক বালিকারা একটা চকলেট ফ্রি পেয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি যায়। তারাই পাড়ায় পাড়ায় খরিদ্দার জোগাড় করে নিয়ে আসে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আলীম সাহেব একদিন অবাক হয়ে গেলেন অল্প বয়স্ক এই বালকের কৌশল প্রয়োগ করতে দেখে। তার সাত বছরের মেয়ে লিন্ডা ক্লাশ টু-তে পড়ে। তিনি প্রতিদিন সাইকেলে চড়িয়ে তাকে নিয়ে আসেন আবার ছুটির পর নিয়ে যান। প্রায়ই তিনি লক্ষ্য করেন তার মেয়ের ব্যাগের মধ্যে বই খাতা ছাড়া কিছু না কিছু দ্রব্যসামগ্রী থাকে। প্রথম প্রথম তিনি মনে করতেন হয়ত বাড়ি থেকে কেউ কিছু নিতে বলেছে তাই কিনে এনেছে। একদিন তার খেয়াল হলো, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সংসার চালিয়ে আসছেন। কিন্তু এমনভাবে খুঁটিনাটি দ্রব্যসামগ্রী দিনের পর দিন জোগান দিতে হয়নি। বর্তমান এই ছোট্ট মেয়েটি দিয়ে তা সমাধা করা হচ্ছে, এতদিন কে তা করতো! প্রয়োজন হলেও আমাকে বিরক্ত করা হবে বলেই কি সবাই এড়িয়ে থাকতো! সেদিন রাতে তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন- জানি সংসার চালাতে গেলে মোটামুটি সাথে ছোট খাটোরও প্রয়োজন হয়, তা আমাকে না বলে এতটুকু মেয়ে লিন্ডাকে বলা হয় কেন?

    স্বামীর প্রশ্নে স্ত্রী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি বিস্মিত হয়ে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন- তোমার এ কেমন ধরনের কথা। আমি তো কিছুই বুঝলাম না।

    ওর কাছে মাঝে মাঝে এটা ওটা কিনতে দেয়া হয় কিনা তাই বলছি।

    ওমা সে কী কথা! তুমি থাকতে আমি দুধের মেয়ের সাথে বলতে যাব কেন?

    এই ধরো মাও তো বলতে পারেন।

    মায়ের পান-তামাক নিয়ে কথা! তুমি তো সবকিছুই এনে দাও, লিন্ডাকে বলবেন কেন?

    আমরা তো জানি মা তাকে কত ভালবাসেন! রাতের বেলা কাছে রাখেন দিনের বেলা স্কুলে থাকে। না দেখতে পেলে তিনি ছটফট করেন। আর আদরের নাতিনী স্কুল থেকে এলেই যেন কাছে পান তাই হয়তো এমন কৌশল নিতে পারেন।

    আমি সকালে মায়ের কাছে জেনে দেখবো।

    না তিনি হয়ত মনে ব্যথা পাবেন। আবার লিন্ডাকেও জিজ্ঞেস করা যাবে না। তার কচি মন না জানি বিগড়ে যায় কিনা। তুমি এসব নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করো না। আমি সব বের করে ফেলবো।

    নিচের ক্লাস আগে ছুটি হয়ে যায়। ছোট ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে যেয়ে শহীদের দোকানের সামনে ভিড় করে দাঁড়ায়। যার যা কেনার দরকার কিনে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুট দেয়। প্রধান শিক্ষক আব্দুল আলীম সাহেব দূর থেকে খেয়াল করলেন- কয়েকটা ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। শহীদ তাদের হাতে একটি করে চকলেট গুজে দিলো। তারা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো কিন্তু কেউ পয়সা দিলো না। তার মেয়ে লিন্ডাও তাদের মধ্যে ছিলো। তাকেও তিনি চকলেট নিতে দেখেছেন। অথচ পয়সা দিতে দেখলেন না। ছেলে-মেয়েরা দোকান ছেড়ে চলে গেলে তিনি দোকানের সামনে যেয়ে দাঁড়ালেন। শহীদ শিক্ষকদের খুব সম্মান করে। সালাম জানিয়ে বললো- ভেতরে এসে বসুন স্যার।

    তিনি একটি টাকা শহীদের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন- তোমার পয়সাটা নিয়ে নাও।

    অবাক হয়ে শহীদ স্যারের দিকে চেয়ে বললো- কিসের পয়সা স্যার?

    ঐ যে লিন্ডা চকলেট নিয়ে গেলো।

    শহীদ হেসে ফেললো। বললো- ও চকলেট তো আমি বিক্রী করার জন্য রাখি না স্যার! কম দামের চকলেট আমি পুরস্কার দেয়ার জন্য এনে রাখি।

    কিসের পুরস্কার?

    যারা আমার দোকানের মাল বেশী কেনে তাদের আমি একটি করে চকলেট ফ্রি দিই।

    তুমি গরিবের ছেলে, যাদের দাও তাদের মা বাবার অবস্থা ভাল ফ্রি নেবে কেন?

    স্যার! না দিলে আমার লাভ হয় কম, দিলে বেশী হয়।

    সে কী কথা!

    এক টাকায় এক ডজন কিনি। ওগুলো ফ্রি দিলে ওরা নিজের বাড়ির না লাগলেও পরের বাড়ির খদ্দের জোগাড় করে নিয়ে আসে। তাতে আমার বিক্রী হয় বেশী, লাভও হয় অনেক।

    আব্দুল আলীম সাহেব এতটুকু একটা বালকের বুদ্ধির কৌশল দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন- এমন মূল্যবান কত মেধাবী ছেলে-মেয়ে অনাদরে অবহেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার খোঁজ কেউ রাখে না। যদি এদেরকে একটু সাহায্য করা যায় তাহলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে পারে। তাতে কেবল ওদের উপকার হবে না আরও দশের জন্য তারা কিছু করতে পারে। তিনি বললেন- শহীদ, তুমি লেখাপড়া করতে চাও।

    মুচকি হেসে সে বললো- স্যার, আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কোনো ভিটে বাড়ি নেই। পরের জায়গায় থাকি। বাপজান মাঠে কাজ করে, আমি দোকানে বেচাকেনা করি- তাই দিয়ে সংসার চলে। আমাদের কি লেখাপড়া হয়!

    তুমি একটুও পড়তে পারো?

    ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছি, থ্রি-তে উঠে আর পড়া হয়নি।

    দ্বিতীয় শ্রেণী পড়ে তোমার এমন পাকা বুদ্ধি! ঠিক আছে আমি তোমাকে বই দেবো। তুমি দোকানে বসে বসে পড়বে। পরীক্ষার সময় তোমাকে কোনো ফি দিতে হবে না। আমি এমনিই তোমার পরীক্ষা নেবো কেমন?

    শহীদ তখনই দোকান থেকে নেমে এসে স্যারের পায়ে হাত দিয়ে পদধুলি নিলো। বললো- স্যার! তাহলে আমার খুব মজা হবে। তার মুখে আনন্দের হাসি। হঠাৎ শহীদের এমন সম্মান জানানো এবং তার মুখে উচ্ছ্বসিত হাসি দেখে আলীম সাহেব চমৎকৃত হলেন। তিনি তখনই তাকে সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর একসেট বই দিয়ে দিলেন। শহীদ আনন্দের আবেগে আর একবার স্যারের পদধুলি নিয়ে বইগুলো বুকে চেপে ধরে নাচতে নাচতেই যেন দোকানে যেয়ে উঠলো। সেইদিন থেকে দোকানে বেচাকেনার ফাকে যখনই সুযোগ পায় তখনই বই খুলে বসে। পড়ার সুবাদে তার কিছু বন্ধুও জুটে গেলো। কমলাপুর গ্রামের কালাম মেম্বারের ছেলে শমসের ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। সে ক্লাসের ফাস্ট বয়। একই গ্রামের পূর্ব পাড়ায় শহীদরা থাকে আর শমসেরদের বাড়ি পশ্চিম পাড়ায়। তারপর আবার দোকানের সূত্রে আগে থেকেই তাদের ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ইদানিং হেড স্যার শহীদকে তাদের স্কুলে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি করে বই দিয়েছেন, তাই প্রতিটি ছেলে-মেয়ের মতো শমসেরদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেছে। স্কুলে কোন্দিন কি পড়ানো হলো, কোথায় পড়া দিয়েছে, কোন্ অংক করা হয়েছে বাড়ি থেকে কি কি কাজ করে আনতে বলেছে, সবকিছু শহীদ প্রতিদিনই তার বন্ধু শমসেরের কাছ থেকে জেনে নেয়। সে মাঝে মাঝে তাকে বিস্কুট, চকলেট খেতে দেয়। ঐ বাজারে আরও কয়েকটা দোকান আছে। হাটবার ছাড়া আর কোনো দিন তাদের দোকানে বেচাকেনা হয় না। কেননা স্কুলের ছেলে-মেয়েরাই হচ্ছে খরিদ্দার। তারা প্রায় সবাই শহীদের দোকানে ভিড় করে। এতে অন্য দোকানদারদের হিংসা হলেও তারা কিছু করতে পারে না। ছেলে-পেলের ব্যাপার না হয়ে সেয়ানা হলে হয়ত নানান দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে সরিয়ে আনা যেতো। ছোটদের বুদ্ধিশুদ্ধি অন্যরকম। যেদিকে একবার মজে যায় সেইদিক থেকে সরিয়ে আনা খুব কষ্টকর। তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। শহীদকে বই হাতে পড়তে দেখলে তারা টিটকারী করে। বলে পাছায় কাপড় নেই তা আবার মাথায় গামছা বাঁধা! বাবা মালকোচা মেরে পরের দোরে কাজ করে বেড়ায় আর ছেলের নবাবী দেখো! বিদ্যে শিখে হাকিম হবি নাকি! তাদের ঠাট্টা বিদ্রুপে সে কোনো কথা বলে না। মাথা নীচু করে বসে থাকে।

    যেদিন হেড স্যারের কাছ থেকে বই পেয়েছিলো সেদিন শহীদ বিকেল বেলা দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়। দূর থেকে তাকে এই অবেলায় বাড়ি আসতে দেখে তার মায়ের অন্তরে হঠাৎ যেন কোন্ অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো! ভীতচকিত হরিণীর ন্যায় সেইদিকে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকলো। প্রতিদিন তার বাবা সন্ধ্যার সময় বাজারে যেয়ে সেখানে মাগরিবের নামায পড়ে। সারাদিন মাঠে ঘাটে যাদের সাথে কাজ করে তাদের মধ্যে দু’চার জন আসে। তাদের সাথে নানান কথা বার্তা বলে। আগামী দিন কোন্ মাঠে কার কাজে যেতে হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। ওরা ছয়জন এক সঙ্গে দলবদ্ধভাবে কাজ করে। তাদের দলের সর্দার হচ্ছে রজব আলি মোড়ল। সে-ই কাজের খোঁজ খবর নেয়। যখন মাঠে ঘাটে কৃষি কাজের চাপ বেশী তখন আর খোঁজ নিতে হয় না। গৃহস্থরা নিজের তাগিদে রজব আলির কাছে আসে। আগে বাড়ি যেয়ে খুঁজতে হতো। এখন আর তার বাড়ি যেতে হয় না। সন্ধ্যার পরে বাজারে কাজিম শেখের দোকানে এলেই তাকে পাওয়া যায়।

    এতে শেখের আবার প্রতিদিন গোটা পাঁচেক টাকা বাড়তি খরচ হয়। তার সঙ্গীদের চা পান খাওয়াতেই ব্যয় হয়ে যায়। তাদের দোকানের কাছাকাছি আফজালের একটা চায়ের দোকান আছে। সদা হাসি মুখ মধ্যবয়সী এই মানুষটি খুব ধর্মভীরু। সামান্য কিছু লেখাপড়াও জানে। কোথাও না গেলে বা কোনো কাজে ব্যস্ত না থাকলে তিনি বাজারের এই ওয়াক্তিয়া মসজিদে আযান দেন, নামায পড়ান। ছয় সন্তানের জনক। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য দু’টি ছেলে হয়েছিলো তা অল্প বয়সেই মারা গেছে। চার মেয়ে, দু’টি বিয়ে হয়ে গেছে। দু’টি এই প্রাইমারীতে পড়ে। সেজটি ফাইভ আর ছোটটি থ্রি-তে পড়াশোনা করে। আগে জমি ক্ষেত নিজেই চাষবাস করতেন। ছোট ছেলেটি দু’বছর আগে মারা গেলে সেই থেকে নিজে আর মাঠের কাজ করেন না। বিঘে আটেক জমি আছে তা ভাগে দিয়েছেন, তাতে সংসার ভালভাবে চলে যায়। মাত্র কাঠা দশেক জমি হাতে রেখেছেন, তরি-তরকারী চাষ করতে। বাজারের নিকটেই তার বাড়ি বিধায় প্রতিদিন ভোরে এসে মসজিদে ফজরের আযান দেন। নামায পড়ে দোকান খোলেন। গ্রামে বাজার হওয়াতে এখানকার মানুষের সকালে বিকালে চা-পান খাওয়া একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কি গরিব, কি ধনী সবাইকে কিছু সময় চায়ের দোকানে না বসলে যেন তৃপ্তি মেটে না। দোকানের সামনে তিন দিক ঘিরে বাঁশের চটার বেঞ্চি পাতা। অনেক মানুষ সেখানে বসতে পারে। সকাল বেলা কাজে যাওয়ার আগে গা গরম করতে গরম পানির লাল চা খেয়ে জর্দা দেয়া পান মুখে পুরে একটি বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে মাঠের দিকে যায়। সকাল আটটার পর আর মানুষ থাকে না। আফজাল মিয়া তখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়। দু’টো পান্তা ভাত খেয়ে বিশ্রাম নেয়। স্ত্রী পান সাজিয়ে বাটাটি এগিয়ে দেন। তিনি একটি পানের খিলি তুলে মুখে পুরে দেন। জর্দার কৌটা থেকে কিছুটা বাম হাতের তালুতে ঢেলে নিয়ে হাতমুঠা করে চোখ বুজে পান চিবুতে থাকেন। এক সময় হাতের মুঠা খুলে মুখের কাছে নিয়ে যেয়ে হা করে জর্দাগুলো চিবানো পানের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। কিছুক্ষণ জাবর কাটিয়ে নিড়ান কাস্তে নিয়ে তরকারীর ক্ষেতে চলে যান।

    বিকেলে বাজারে এসে আসরের নামায পড়ে দোকান খোলেন। লোকজন আসতে শুরু করে। মাগরিবের পরে খুব ভীড় হয়, তখন একা সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যান। কাজিম শেখ প্রতিদিনই ঐ সময় তাকে সাহায্য করে। চা পানের সাথে চলে রাজ্যের গল্প। রাজনীতি, সমাজনীতি, শালিস, বিচারের ব্যাপারে মুখে মুখে তুফান ছুটে। এখানে গরিব-ধনীর ব্যবধান থাকে না। সবাই যেন নেতার গলায় কথা বলে। প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত হৈ হুল্লোড় চলে। তারপর আফজাল মোড়ল দোকান বন্ধ করে এশার নামায পড়ে হারিকেন হাতে বাড়ি চলে যায়। কাজিম শেখও তার সাথে নামায পড়ে ছেলে শহীদকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। শহীদের মা ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে দু’টি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে হারিকেনের আলোয় কাঁথা সিলাই করতে থাকে। গলার আওয়াজ পেলেই তাড়াতাড়ি কাঁথা গুটিয়ে ছুটে ঘরের বাইরে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মুখে একটা চুমা দিয়ে ঘরে নিয়ে যায়। দোকান দেয়ার পর থেকে আজ এই প্রথম ব্যতিক্রম দেখে মায়ের মন তো শঙ্কিত হওয়ার কথা। মাকে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শহীদ এক দৌড়ে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো- মা, এই দেখো হেড স্যার আমাকে পড়ার জন্য বই দিয়েছেন। তার মুখ দিয়ে আনন্দের হাসি যেন উপচে পড়ছে, ছেলের হাসি মুখ দেখে মায়ের অন্তরে স্নেহ যেন উথলে উঠলো। দু’হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে তার মুখমণ্ডল চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলেন। মায়ের মুখে ভুবন ভরা হাসি। দু’চোখে তার আনন্দাশ্রু। মায়ের মুখে হাসি আবার চোখে পানি দেখে শহীদ বললো- মা, তুমি কাঁদছো?

    মা ছেলের মুখে আর একটি চুমো দিয়ে বললো- নারে পাগল, আমি খুশী হয়েছি। আর কিছু বলতে পারলেন না। আঁচল চেপে ধরলেন মুখে। তার হৃদয়ের মাঝখানে কোথায় যেন জমাট বাঁধা ব্যথা হঠাৎ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ছেলের হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। ছেলেকে বুকে চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। শহীদ প্রথমে মায়ের মুখে হাসি দেখেছে তারপর পরই কেন কাঁদছে তা বুঝে উঠতে পারলো না। তার চোখে মুখে বিষণ্ন বিস্ময় জেগে আছে।

    স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা এলো। হেড স্যার শহীদকে বললো মাত্র দু’তিন মাস হলো তুমি বই নিয়েছো এই কয়দিনে আর কতটুকুই বা পড়তে পেরেছো। ভাল করে লেখাপড়া করো, আগামী বছর পরীক্ষা দিও, এবার দিলে হয়ত পাস করতে পারবে না, তাতে আমাকে সবাই ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে। কিন্তু শহীদ নাছোড় বান্দা। সে পরীক্ষা দিবেই। সে বললো- আপনি ভাববেন না স্যার! আমি আপনার সম্মান আরও বাড়িয়ে দেবো। আপনি দো‘আ করুন আমি যেন ভালভাবে পরীক্ষা দিতে পারি। আপনি দেখবেন, আমি ভাল লিখে সবাইকে অবাক করে দেবো। তবু হেড স্যার অমত প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু শহীদ পায়ে ধরে সম্মতি আদায় করে নিয়েছে। হেড স্যারের আশংকা ছিলো গরিবের ছেলে দোকানদারী করে একদিনও ক্লাস করতে পারেনি, পরীক্ষা দিয়ে যদি ফেল করে তাহলে সভাপতি আবুল আসাদ খান সাহেব তাকে তিরস্কার করবেন। খান সাহেব যেমন সহজ সরল মানুষ তেমন প্রয়োজনবোধে কড়া মেজাজে ভয় পাইয়ে দেন। তিনি প্রায়ই স্কুলে এসে ক্লাসে ক্লাসে ঘোরেন, তাই শিক্ষকরা তাকে যমের মতো ভয় করেন। শিক্ষার ব্যাপারে যেমন দান আছে তেমন গুণও আছে। নীচে কি উপরে সব জায়গায় তার সুনাম। স্কুলের বাইরে কাউকে বই দেয়ার নিয়ম নেই। শহীদের কথা বার্তায় অভিভূত হয়ে হেড স্যার কাউকে না বলেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাকে বই দিয়েছিলেন। সভাপতি সাহেবকে বাদ দিয়ে তিনি কোনো কিছুই করেন না কিন্তু শহীদের ব্যাপারটা তাকে জানানো হয়নি। এই কারণেই তার মনে দুর্বলতা ছিলো। শেষ পর্যন্ত ছেলেটির চোখের পানি তার দ্বিধা দূর করে দিলো।

    সময় মতো স্কুলের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। আগেই কথা হয়েছিলো শহীদের যে কয়দিন পরীক্ষা হবে সে আর দোকানে যাবে না, তার আব্বাই দোকান চালাবেন। কিন্তু তা হলো না, সেই সময় আবার মাঠে ঘাটে কাজের চাপ পড়ে গেলো। পরের ক্ষেতে কাজ করে খেতে হয়। তাও আবার বছরের বেশী সময় আসাদ খানের ক্ষেতে-খামারে কাজটা প্রায়ই বান্দাবান্দি। আবার খান সাহেবের জায়গায় কাজিম শেখ বাস করছেন। তিনি জায়গা না দিলে তাকে আরও কতদিন পথে পথে ঘুরতে হতো তার ঠিক নেই। এমন একটা উদার হৃদয় মানুষের কাজ ফেলে সে দোকানে বসবেন! আর দোকানটা বা তিনি করলেন কি করে! কেউ তো জানে না সেই কথা। খান সাহেবের হাতে পায়ে ধরেই তো টাকা ধার নিয়ে এটা করেছিলেন, তিনি যদি সাহায্য না করতেন তাহলে এই দোকানও হতো না তার ছেলের পরীক্ষা দেয়ার প্রশ্নই উঠত না। কেননা সে মাঠে মাঠে ডাংগুলি খেলে বেড়াত। সেই খান সাহেবের কাজ ফেলে দোকানে বসা! হতেই পারে না। প্রতি সপ্তাহে ধারের টাকার যে কিস্তি দিতো তা না হয় ওজর দেখিয়ে সময় নেয়া যাবে। তিনি দয়ালু মানুষ, নিশ্চয় কিছু মনে করবেন না। দোকান বন্ধ থাকলো, কাজিম শেখ খান সাহেবের কাজে বেরিয়ে পড়লেন। শহীদ পরীক্ষা দিতে স্কুলে গেলো। দু’বছর পর সে আবার স্কুলের বেঞ্চিতে বসে পরীক্ষা দিতে পারছে তাতে তার মনপ্রাণ যেন আনন্দের ঢেউয়ে নেচে উঠলো। বালকের হৃদয়ে প্রচণ্ড একটা প্রত্যয় জেগে উঠলো। তার গণ্ডির সব কিছুকে ভুলে প্রশ্নোত্তরে মন সংযোগ করলো।

    দুই

    কাজিম শেখের স্ত্রী আয়নামতিও ভাল কাঁথা সিলাই করতে পারেন। উন্নতমানের নকশী

    Enjoying the preview?
    Page 1 of 1