Discover millions of ebooks, audiobooks, and so much more with a free trial

Only $11.99/month after trial. Cancel anytime.

পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali)
পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali)
পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali)
Ebook305 pages2 hours

পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali)

Rating: 0 out of 5 stars

()

Read preview

About this ebook

স্রষ্টার সৃষ্টি অসীম। যার মধ্যে পৃথিবী নামক গ্রহটি বৃহত্তর মানব জীবনের খেলাঘর বলে ধরে নেয়া যায়। জন্মের পর থেকে জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলী কোনটা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় কোনটা নিরবে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে মনের পাতায় শিহরণ জাগানো কাহিনী যে থাকে না তা নয়; সেটা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলেও শিল্পীর নজর এড়াতে পারে না। তাঁদেরই সোনার হাতের স্পর্শ জীবন্ত হয়ে আগ্রহী মানুষের হৃদয়ে সাড়া জাগায়। তাই অজানার আগ্রহ দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদল বিজ্ঞ গদ্য শিল্পীর হাতেই উদ্ঘাটিত হচ্ছে মানুষের ঘটনাবহুল জীবনের ছায়াচিত্র। যা উপন্যাস নামে আখ্যায়িত হয়ে সাহিত্য জগতকে আলোকিত করে রেখেছে। সেই আলোর উজ্জ্বলতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সূক্ষ্মদর্শী মানুষের দৃষ্টিও প্রসারিত হচ্ছে। প্রসারিত সমাজের দৃষ্টি কাঁড়তে আমার ‘পথের শেষে’ উপন্যাসখানি একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস যার দ্বিতীয় পর্ব ‘সাদা কাগজ’ এটা ব্যর্থ কি সার্থক তা নির্ণয় করার দায়িত্ব পাঠকদের।

LanguageBengali
Release dateMay 2, 2015
ISBN9781310470646
পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali)

Read more from বজলুর রহমান Bazlur Rahman

Related to পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali)

Reviews for পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali)

Rating: 0 out of 5 stars
0 ratings

0 ratings0 reviews

What did you think?

Tap to rate

Review must be at least 10 words

    Book preview

    পথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali) - বজলুর রহমান Bazlur Rahman

    তোহফা

    শ্রদ্ধেয় শিক্ষক

    আবু বকরকে

    আল্লাহ তুমি এ নগণ্য তোহফা

    কবুল করে নাও।

    এক

    সৌভাগ্যই বলতে হবে।

    হ্যাঁ, তাই। নইলে হতাহতের মধ্যে সে অবশ্যই থাকত। বাস এক্সিডেন্টে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে সে থাকতে পারত। নতুবা হাসপাতালে যারা গেছে তাদের সাথে গেলেও যেতে হত। ওযে কোনটাতে নেই সেটাই ওর সৌভাগ্য। ওর খেয়ালী জীবনের কিছু অংশ যেখানে কাটিয়েছে, সেই তারুণ্যের আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের রঙিন দিনগুলোর স্মৃতি আজ ওকে উতলা করে তুলছে। একদিন পরিকল্পনাহীন অনিশ্চিত অজানা পথে বেরিয়ে পড়ে সে কল্পনা করতে পারেনি অনেকগুলো অপরিচিত মানুষের মন কাঁড়তে পারবে। অনেক প্রাণের ভালোবাসা, অনাকাক্সিক্ষত রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, সে যাদের সংস্পর্শে এসে পেয়েছে- তা একটা উত্তম সাহিত্য সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সহায়ক। সে মাঝে মাঝে হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা চিঠিপত্র অনেকের কাছ থেকে পায়, তাতে চঞ্চল না হয়ে সেও প্রেরকের অন্তরে ঢেউ জাগাবার মতো খত লিখে প্রতিউত্তর দিয়ে থাকে। কিন্তু আজকের চিঠিটা তাকে ভীষণভাবে উতলা করে তুললো।

    চিঠিটা লিখেছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল বাসেত খন্দকার। বরিশালের এক নিভৃত পল্লীর উচ্চ বংশের, স্থানীয় ভাষায় খোন্কার বাড়ির ছেলে। অনেকগুলো পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও এই খন্দকার পরিবারের সাথে রাসেদের সম্পর্ক সবাইকে টপকে অনেক উপরে স্থান পেয়েছে। এই পরিবারে তার উচ্চ আসনটি বাসেতের মায়ের কল্যাণেই। তাই রাসেদ, বন্ধুর মাকে নিজের মায়ের সাথে এক নিক্তিতে ফেলে হৃদয়ে স্থান দিয়ে রেখেছে।

    বন্ধু ও বন্ধু-পত্নীর চিঠি আজ পেয়েছে। তাদের রসিকতা রাসেদকে একটুও চঞ্চল করতে পারেনি। তবে একটি মাত্র আবেদন তাকে আলোড়িত করল। নির্দিষ্ট দিন তারিখ ফেলে যাওয়ার পর তাগাদা। এই তাগাদা আর কারও নয়- স্বয়ং মায়ের। এটা মায়ের আদেশ। অতএব বরিশালের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবীদের পাঠানো চিঠির মতো মনে করে কেবলমাত্র উত্তর লিখেই কর্তব্য শেষ করা রাসেদের বিবেকে বাধলো। সে তার মায়ের কাছে গেল।

    মা তো শুনে অবাক! তা যেতে বলেছে বলে আজই?

    তাদের দেয়া সময়ের মধ্যে আবার যেতে হবে তো!

    তুই একদিন বলেছিস তার একটি মাত্র মেয়ে, তাও বিয়ে হয়ে গেছে।

    বলেছি, কিন্তু সেকথা কেন মা?

    মেয়ে থাকলে তো দিন তারিখ ফেলে ডেকে নিয়ে গিয়ে বিয়ের প্রশ্ন আসতো, তা যখন নেই, তখন এতো ব্যস্ততা কেন?

    মায়ের কথায় রাসেদ ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। সে মাথা নিচু করে স্থির হয়ে রইল। তার সমস্ত চেহারা যেন লাল হয়ে গেল। মা বুঝতে পেরে বললেন- তা যেতে বলেছে যাস, দু’দিন পরেই যা, এতো তাড়াহুড়ো কেন?

    মায়ের মুখে হাসি দেখে জড়তা কাটিয়ে রাসেদ বললো- আজ যাচ্ছিনে, আগামীকাল যাব।

    রাসেদ তার মাকে কোনো কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। এখনই তার স্থানীয় বন্ধুদের এই খবরটি না দিলে সে হালকা হতে পারছে না।

    পরদিন মায়ের আবদার, বাবার তিরস্কার আরও অনেক ঝামেলা এড়িয়ে বিকাল তিনটার দিকে রাসেদ বেডিং পত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। স্টেশনে পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেল। তার পৌঁছবার দশ মিনিট পূর্বেই রেলগাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শূন্য স্টেশনটার চতুর্দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখলো আর কোনো যাত্রী তার মতো ট্রেন ফেল করে দাঁড়িয়ে আছে কিনা।

    না। তার মতো কোনো হতভাগা নেই।

    রেল কোম্পানীর এক কর্মচারী রাসেদকে চিনে। তিনি এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন- রাসেদ মিয়া যে! কি ব্যাপার, ট্রেন ফেল করলেন নাকি?

    বুঝতেই তো পারছেন।

    একান্ত জরুরি হয়ে পড়লে তাহলে বাসে যান না! নইলে কাল আসুন আমি আপনার জন্য টিকিট নিয়ে রাখব।

    আমাকে আজই যেতে হবে। আচ্ছা তাহলে বাসেই যাই, কেমন?

    তাই যান।

    রাসেদ ছুটলো বাস স্ট্যান্ডের দিকে।

    স্ট্যান্ডে কয়েকটি বাস দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তার একটিরও ছাড়বার ব্যস্ততা নেই। কাউন্টারে ঢুকে রাসেদ জিজ্ঞেস করলো, বাস কতক্ষণ পর ছাড়বে?

    চল্লিশ মিনিট পর।

    সাড়ে চারটার বাস তাহলে চলে গেছে?

    এইতো পাঁচ মিনিট আগে ছেড়ে গেছে।

    রাসেদ যেন ক্ষেপে উঠলো। রাগে গর গর করতে করতে বললো- কেন পাঁচ মিনিট পরে ছাড়বার আদেশ দিতে পারেননি! যতসব!

    রাসেদের ধমক শুনে ম্যানেজার থতমত খেয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি এর জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ভদ্রভাবে বললেন- শান্ত হোন। আমাদের সময় নিয়ে সজাগ থাকতে হয়। আপনি সময়মত আসতে পারেননি বলে নিজেকে তিরস্কার করতে পারেন, আমাদের উপর দোষারোপ করতে পারেন না।

    সেই মুহূর্তে রাসেদ আর কি বলবে খুঁজে না পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। চারপাশে বেশ কিছু লোকজন ছিল তারা ওর ভাব সাব দেখে মুখ টিপে হাসছিল। পরিচিত একজন এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বললো- এই অবেলায় আর কোথাও না গিয়ে আমাদের বাড়ি চল।

    রাসেদ কোনো কথা না বলে এক হ্যাচ্কা টানে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। বাড়ি গিয়ে কারও সাথে কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকল। এই যে যেতে পারল না, তার জন্যে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবে! নিজের প্রতি না তার ভাগ্যের প্রতি- এই নিয়ে সে মানসিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল।

    সন্ধ্যা সাতটার সময় তার ছোট ভাই বাজার থেকে ফিরে এসে সংবাদ দিল- সাড়ে চারটার বাস ঝিকরগাছা বাজারের নিকটে ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে উল্টে গেছে। ড্রাইভারসহ কয়েকজন যাত্রী মারা গেছে, বাকী সবাই আহত হয়ে হাসপাতালে। সংবাদটি শোনামাত্রাই রাসেদ লাফ মেরে উঠে মায়ের কাছে ছুটে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে ভাগ্যের যে স্থানটিতে এতোক্ষণ মলিন ধুলা লাগাচ্ছিল সেখানে এখন ফুল ছিটাতে লাগল।

    রাসেদের স্থানীয় বন্ধুরা মনে করেছিল যেরকম একগুঁয়ে ছেলে সে, নিশ্চয় কারও বাধা না মেনে নির্দিষ্ট সময়ে চলে গেছে। সেদিনই সন্ধ্যার পরে তারা যখন জানতে পারল নির্দিষ্ট সময়ের সেই গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে যাত্রীদের কেউ গেছে কারও যায় যায় অবস্থা। তারা মনে করল এই যায়-যায়ের মধ্যে রাসেদও তো থাকতে পারে। সত্যিই সে গেছে কিনা এই সংবাদটা পাওয়ার জন্যে তারা অস্থির হয়ে পড়ল। রাতটা কোনো রকম চোখ কান বুজে কাটিয়ে পরদিন সকালেই ছয়জন বন্ধু একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাসেদদের বৈঠকখানায়। ঘরে ঢুকে তারা একেবারে ‘থ’- তারা ভেবেছিল পরিবারের অন্য সদস্যদের কান্নাকাটি শুনবে। রাসেদের মৃত্যু সংবাদে তারাও সমবেদনা জানিয়ে গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করবে। কিন্তু তাদের মনে করাটা যে অর্থহীন তা তখনই প্রমাণ হয়ে গেল। বৈঠকখানায় ঢুকে তারা দেখলো- রাসেদ দিব্বি আরামে চেয়ারে হেলান দিয়ে ‘কোতোয়ালের যা দেখেছি’র পাতায় ডুবে আছে।

    এতো সকালে বন্ধু-বান্ধব তার বৈঠকখানায় দেখে সেও রীতিমত অবাক হয়ে গেল। পরক্ষণে খেয়াল হল, গতকালের বাস এক্সিডেন্টের কথা শুনে নিশ্চয়ই তার বন্ধুরা এসেছে। সে একটু কৌতুক করে বললো- তোরা যখন এসেছিস তখন বসে যা, আমি মায়ের কাছে সংবাদটা দিয়ে আসি।

    কি সংবাদ দিবি?

    মাকে বলব- আমি তো একদিন মরবই, সেই উপলক্ষে তোমরা মীলাদ মাহফিলের আয়োজন নিশ্চয় করবে, সেটা মৃত্যুর আগেই হয়ে যাক এবং আজই। বিশেষ করে বন্ধুরা যখন সেই উদ্দেশ্যেই এসেছে।

    কথা শুনে উপস্থিত সবাই ভীষণভাবে চমকে উঠল। ওরে বাবা, একী সর্বনাশের কথা! দোহাই বন্ধু! দয়া করে অমন কথাটি তুই বলিস না।

    কেন বলব না! তোরা এই মনোভাব নিয়েই যখন এসেছিস। কি বলিস মাহি?

    মাহি নামের বন্ধুটি এসে এ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি। তারও কারণ আছে। রাসেদ মেধাবী ছেলে, আবার স্বভাব চরিত্রে, ব্যবহারে উত্তম। তাই ভালো ছেলেদের প্রতি তার একটা আন্তরিক টান আছে। আর যারা পোশাক-আশাকে বাহাদুরি করে বেড়ায়, আসল জায়গায় অষ্টরম্ভা রাসেদ তাদের সব সময় এড়িয়ে চলে। মাহি হচ্ছে শেষাক্ত দলের। উভয়ে উভয়কে এতদিন এড়িয়ে এসেছে। হঠাৎ আজ রাসেদের খোঁজে তাও আবার একেবারে তাদের বাড়িতে। মাহি মনে করেছিল বাস এক্সিডেন্টে রাসেদ হয়ত মারাই গেছে। কিন্তু এসে যখন দেখলো রাসেদ স্বশরীরে বিদ্যমান তখন মনে মনে যমদূতকে বার বার ধিক্কার দিয়ে খাটের এক কোণে গিয়ে চুপ করে বসেছিল। রাসেদ কিন্তু দৈবভাবেই তার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিল, তাই তাকে আরও ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যে প্রশ্নটি তাকেই করল। মাহি কোনো উত্তর না দিয়ে তার গোমড়া মুখটি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। রাসেদও ছাড়বার পাত্র নয়। সে পুনরায় বললো- মাহিরা যখন খাওয়ার জন্যেই এসেছে তখন সেই ব্যবস্থা করি গিয়ে। আমি মায়ের কাছে উত্তম খাদ্যদ্রব্য জোগাড় করতে বলেই সরে পড়ব। তোরা সবাই পেট বোঝাই করে খেয়ে যাবি কিন্তু।

    আর তুই?

    আমি নব বধূর মতো চুপ চাপ ঘরের কোণটিতে বসে থাকব।

    ঠাট্টা করছিস?

    কেন?

    তা নয়ত কী?

    তোরা যে খাওয়া খেতে এসেছিস সামনে থাকলে সেই খাওয়ায় কোন আনন্দ পাবিনে। অতএব আমি চোখের আড়ালে থাকলে তৃপ্তিসহকারে খেতে পারবি।

    কয়েক বন্ধুতে মিলে একচোট হাসির হল্লা বইয়ে দিল।

    প্রথম জীবনে একটা মরণযাত্রা থেকে রাসেদ বেঁচে গেছে, তাই তার বাবা-মা ছেলের আত্মার মঙ্গলের জন্যে সত্যিই মীলাদ শরীফের ব্যবস্থা করে স্রষ্টার দরবারে হাজারো শুকরিয়া আদায় করলেন।

    সপ্তাহ যেতে না যেতে রাসেদের মন আবার উতলা হয়ে উঠলো। মা ছেলের ভাবগতি দেখে বললেন, একান্তই যদি যেতে হয় তাহলে আরও কিছুদিন পরে যা। সে মায়ের কথা ফেলতে পারে না আবার নিজের মনটাকে শান্তকরতেও পারছে না। প্রায় চার বছর গত হয়ে গেছে। কেবল চিঠিপত্র আদান প্রদান ছাড়া দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। অনেকগুলো মুখ তার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। কয়েক মাস তাদের সাথে আনন্দ-ঘন দিন কাটিয়েছে, যা জীবনের পাতা থেকে মুছে ফেলবার নয়। বিশেষ করে মাধবী আর বন্ধু বাসেতের মায়ের আকর্ষণটা সে বেশি করে অনুভব করছে। কি জানি কি মায়া, কি মধু জড়িয়ে আছে সেই মায়ের চেহারায়। রাসেদের খাওয়া-ঘুমে অনিয়ম হলো। তা দেখে মা অস্থির হয়ে পড়েন। বলেন বসে বসে কি যে ভাবিস তা কিছুই বুঝিনে। এতবড় বিপদটা মাথার উপর দিয়ে গেল তাই বললাম আরও কিছুদিন পরে যা। ওমা, একরত্তি ছেলে কি সেই কথায় ভোলে! বন্ধু-বান্ধব কত ছেলেরই তো আছে, কিন্তু এ বাবা কেমন বন্ধু যে মনে পড়লেই ছুটতে হবে! উঠ দেখি, নাওয়া-খাওয়া করে নে। এতো বেলা হয়ে গেল তবু ওঠার নামটি নেই। না খেয়ে যে একেবারে কাঠ হয়ে গেলি।

    রাসেদ অত্যন্ত মেধাবী ছেলে। তাই স্কুল জীবনে প্রতিটি ক্লাশে প্রথম আসনটি সে বরাবর পেয়ে এসেছে। এর জন্য তার যেমন সুনাম আছে, তেমন একটি দুর্নামও আছে। সে প্রায়ই ক্লাশে অনুপস্থিত থাকত। যখনই সুযোগ পেত তখনই সে একদিক বেরিয়ে পড়ত। শৈশব থেকেই তার প্রবল আগ্রহ অজানারে জানা। তাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের বাড়ি বহুবার সে গিয়েছে। মাঠ-ঘাট-প্রান্তর সে চষে বেড়িয়েছে। আত্মীয়ের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবের আত্মীয়, কোথাও বাদ দেয়নি। পাড়া গাঁয়ের ছেলে কেবল গাঁও গ্রামই সে ঘুরে ঘুরে দেখেছে। বাইরে বলতে নিজ জেলা শহর ছাড়া আর কোন শহর-বন্দর সে দেখেনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাইরের দুনিয়ার সাথে পরিচিত হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। বছর চারেক আগের কথা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। পড়া-লেখার ঝামেলা নেই। এই সুযোগে একদিন কাউকে কিছু না বলে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। ঘর ভোলা বাঙালীর ছেলে সে। কোনো দিক নির্দেশনা না নিয়েই বেরিয়ে পড়ল। কোথায় যাবে সে! কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি! না, আর আত্মীয় বাড়ি নয়। এবার সে কোনো দূর দেশে যাবে। অপরিচিত স্থান। যেখানে কেউ তাকে চেনে না, জানে না। এবার সে নতুনের সন্ধানেই পথে পা বাড়াল। রেল স্টেশনে পৌঁছতেই মফিজের সাথে দেখা। ব্যাগ ঘাড়ে রাসেদকে দেখেই মফিজ জিজ্ঞেস করলো- কোথায় যাবি রাসেদ, ঢাকায় নাকি?

    রাসেদের ক্লাশ ফ্রেন্ড মফিজ। সে ধনী লোকের ছেলে। পড়া লেখায় সে কোনো সময় ভালো ছিল না। সহজে কোনদিন ক্লাশ ডিঙ্গাতে পারেনি। শিক্ষকদের হাতে পায়ে ধরে পার পেতে হয়েছে। তবু তার চেহারা কোনদিন ম্লান হয়নি। সে একদিক দিয়ে ছিল ক্লাশের সবার উপরে। তার মুখ দিয়ে যেন সব সময় খৈ ফুটত। সে খুব গল্প করতে পারত। আর সেসব বানানো বা কোনো আজগুবি গল্প নয়। তার নিজের ভ্রমণ কাহিনী আর চোখে দেখা সব বাস্তব গল্প। সে বড় বড় শহর-বন্দর ঘুরেছে, নদী-সাগর-পাহাড়-পর্বত দেখেছে। চোখে দেখা বাস্তব সূত্রগুলোই তার গল্পের সম্পদ। সেসব জীবন্ত কাহিনীও গড় গড় করে বলে যায় আর খুব গর্ব অনুভব করে। সে প্রায়ই বলে থাকে, তোরা সব বই-খাতা নিয়ে বছর ভর ঘরের কোণে পড়ে থাকিস। পড়া লেখাই কেবল বুঝিস, দেখলিনে তো কিছুই। ঘরের বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতির শোভা মন দিয়ে উপভোগ করতে না পারলে প্রকৃত জ্ঞানার্জন করা যায় না, তা বুঝিস?

    বেনাপোল রেল স্টেশনে পৌঁছেই সেই জ্ঞানী বন্ধুটির সাথে রাসেদের দেখা হয়ে গেল। তারপর আবার যখন সে রসিকতা করেই জিজ্ঞেস করলো ‘ঢাকা যাবি নাকি’? তখন রাসেদ নিজেকে সঙ্কুচিত না করে অতি গর্বের সাথে বললো- হ্যাঁ, ঢাকা যাব।

    সত্যি?

    জানিস তো- আমি কোনদিন মিথ্যে বলিনে?

    আমার সাথে ইয়ার্কি-হুঁ! টাকা দে দেখি, টিকিট এনে দিই।

    রাসেদ পকেট থেকে একখানি দশ টাকার নোট বের করে মফিজের হাতে দিয়ে বলল- এখান থেকে এক গাড়িতে তো আর ঢাকা যাওয়া যাবে না, তুই ভাই খুলনা পর্যন্ত একখানা টিকিট এনে দে, ওখানে আমার বিশেষ কাজ আছে। আগামীকাল খুলনা থেকে স্টিমারে বরিশাল হয়ে ঢাকা যাব। খুব মুরুব্বিয়ানার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেল রাসেদ। মফিজ অবাক হয়ে শুনল তার কথাগুলো। এখান থেকে সোজাসুজি এক গাড়িতে ঢাকা যাওয়া যাবে না, তা রাসেদ জানল কী করে? তার তো জানার কথা নয়? সে তো কোনদিন শহরে যায়নি! সে কেবল গাঁও গেঁরাম ঘুরেছে, বড়জোর যশোর পর্যন্তই তার দৌড়। আজ প্রথম বেরিয়েই বরিশাল! ডাঙ্গার ছেলে সোজা পানির দেশে! এও কি সম্ভব! মফিজ মনে করলো রাসেদ তার সাথে ঠাট্টা করছে। হয়ত কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছে।

    সত্যি তুই বরিশাল যাবি?

    যাবই তো বলছি।

    মফিজ তবু বিশ্বাস করতে পারেনি, বিস্মিত হয়ে বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে রইল! রাসেদের তাগাদায় সে খুলনা পর্যন্ত একখানা তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট নিয়ে এলো।

    আসি মফিজ, দোয়া করিস। রাসেদ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। বরিশাল এক্সপ্রেস হুইসেল দিয়ে আস্তে আস্তে প্লাট ফরম পার হয়ে গেল। রাসেদ রুমাল নাড়িয়ে বন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছিল, আর

    Enjoying the preview?
    Page 1 of 1