মুক্তির সূর্যোদয় (উপন্যাস) / Muktir Surjodoy (Bengali)
()
About this ebook
কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ঘটনাবহুল জীবনের অনেক ক্ষেত্রে সত্যের মতো মিথ্যে অভিনয়ও করতে হয়। বাস্তবতার নিরিখে তা জীবন্ত বলেই অনুভূত হয়। এমনই একটা কাহিনী নিয়ে মুক্তির সূর্যোদয় উপন্যাসখানি লেখা। এর মধ্যে বিস্ময়ভরা করুণ আর্তনাদ যেমন আছে, তেমনি প্রাণের স্পন্দনও আছে। মুক্তির সংগ্রামে আত্মত্যাগী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী অভিযানের অনেক বাস্তব চিত্র আজও অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। আমার ক্ষুদ্র শক্তি দ্বারা যতটুকু পেরেছি, সে ঢাকনী কিছুটা উন্মোচন করে যে তথ্যটুকু বের করতে পেরেছি, তা ইতিহাসের আদলে না লিখে উপন্যাস আকারে লেখা হলো। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব সত্যকে এমন নিপুণতার সাথে দেখানো হয়েছে, যা পাঠকের কাছে অবিশ্বাস্য বলে প্রতীয়মান হতে পারে, কিন্তু তা মিথ্যে নয়। মিথ্যার মতো শোনালেও তা সত্য। এমন অজস্র কাহিনী রূপসী বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কান পেতে শুনলে কান্নার করুণ সুর শুনতে পাওয়া যাবে।
এই উপন্যাসে যাদের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাদের অনেকেই আজ বাংলার এই শস্য শ্যামল ভূমির ঘ্রাণ অদৃশ্য জগৎ থেকে আহরণ করছেন। যাদের জীবনের স্পন্দন আজও বয়ে যাচ্ছে মুক্ত ভূমির অলিতে-গলিতে- এতিমের মতো অবহেলিত হয়ে, জাতি কি তাদের কাছে ঋণী নয়? আত্মত্যাগীদের মূল্যায়ন আর কতকাল পরে হবে? জাতির বিবেক বলে পরিচিতদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।
Read more from বজলুর রহমান Bazlur Rahman
অপরূপ(একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস) (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsসাদা কাগজ (উপন্যাস) / Shada Kagoj (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsঅপূর্ব পৃথিবী (একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস) (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsআলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsপথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsনিয়তি নিরন্তর (উপন্যাস) / Niyoti Nirontor (Bengali) Rating: 5 out of 5 stars5/5সোনার হাতের পরশ (উপন্যাস) / Shonar Hater Porosh (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratings
Related to মুক্তির সূর্যোদয় (উপন্যাস) / Muktir Surjodoy (Bengali)
Reviews for মুক্তির সূর্যোদয় (উপন্যাস) / Muktir Surjodoy (Bengali)
0 ratings0 reviews
Book preview
মুক্তির সূর্যোদয় (উপন্যাস) / Muktir Surjodoy (Bengali) - বজলুর রহমান Bazlur Rahman
মুক্তির সূর্যোদয়
কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ঘটনাবহুল জীবনের অনেক ক্ষেত্রে সত্যের মতো মিথ্যে অভিনয়ও করতে হয়। বাস্তবতার নিরিখে তা জীবন্ত বলেই অনুভূত হয়। এমনই একটা কাহিনী নিয়ে মুক্তির সূর্যোদয় উপন্যাসখানি লেখা। এর মধ্যে বিস্ময়ভরা করুণ আর্তনাদ যেমন আছে, তেমনি প্রাণের স্পন্দনও আছে। মুক্তির সংগ্রামে আত্মত্যাগী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী অভিযানের অনেক বাস্তব চিত্র আজও অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। আমার ক্ষুদ্র শক্তি দ্বারা যতটুকু পেরেছি, সে ঢাকনী কিছুটা উন্মোচন করে যে তথ্যটুকু বের করতে পেরেছি, তা ইতিহাসের আদলে না লিখে উপন্যাস আকারে লেখা হলো। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব সত্যকে এমন নিপুণতার সাথে দেখানো হয়েছে, যা পাঠকের কাছে অবিশ্বাস্য বলে প্রতীয়মান হতে পারে, কিন্তু তা মিথ্যে নয়। মিথ্যার মতো শোনালেও তা সত্য। এমন অজস্র কাহিনী রূপসী বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কান পেতে শুনলে কান্নার করুণ সুর শুনতে পাওয়া যাবে।
এই উপন্যাসে যাদের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাদের অনেকেই আজ বাংলার এই শস্য শ্যামল ভূমির ঘ্রাণ অদৃশ্য জগৎ থেকে আহরণ করছেন। যাদের জীবনের স্পন্দন আজও বয়ে যাচ্ছে মুক্ত ভূমির অলিতে-গলিতে- এতিমের মতো অবহেলিত হয়ে, জাতি কি তাদের কাছে ঋণী নয়? আত্মত্যাগীদের মূল্যায়ন আর কতকাল পরে হবে? জাতির বিবেক বলে পরিচিতদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।
বজলুর রহমান
যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে
স্বাধীনতা পেয়েছি তাদের স্মরণে।
এক
অবসর গ্রহণ করার পর ঝানু কূটনীতিক আলমগীর খান নিজেকে বড় অসহায় মনে করছেন। তিনি যোগ্যতাবলে চাকুরি জীবনে প্রভূত উন্নতি করতে পেরেছেন। বিভিন্ন স্তর পাড়ি দিয়ে শেষে পর পর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে কূটনীতিকের দায়িত্ব বেশ সুনামের সাথে পালন করেছেন। বহু জাতি-গোষ্ঠীর কর্ণধার থেকে নিয়ে জ্ঞানী-গুণীদের সাথে অবাধ মেলামেশা করতে হয়েছে। তাই দেশে-বিদেশে অগণিত বন্ধু-বান্ধব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবু তার মাঝে সর্বদা এক বিরাট শূন্যতা বিরাজ করছে। কিন্তু বর্তমানের মতো এমন করে পীড়ন করতে পারেনি। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার মানসে নিজের কর্তব্য কর্মের মধ্যে ডুবে থাকতেন বিধায় নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। এতোদিন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করতে পারায় উচ্চ মহলে যেমন সুনাম অর্জন করতে পেরেছেন তেমনি নিজের মনের দিক থেকে ছিলেন বিজয়ের আনন্দে পরিপূর্ণ।
জীবনের প্রথম লগ্নে মস্ত এক আঘাত তার চলার পথে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। ব্যথাভরা হৃদয়ের ভাঙন ঠেকাতে সাধনা করে উঁচু স্তরের পদ পেয়েছিলেন। বড় পদে বড় কাজ মনে করে তার মধ্যেই সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন। আঘাতপ্রাপ্ত ব্যথার সূক্ষ্ম আঁচড় সেখানে অনুভূত হলেও তার তীব্রতা বাড়তে দিতেন না, আগামী দিনের কাজের পরিকল্পনা তৈরিতে মনোনিবেশ করতেন। হৃদয়ের নিভৃত কোণে জমাটবাঁধা বেদনা ভুলে থাকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু যা ভোলা যায় না তা ভুলবেন কি করে! গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও মাঝে মাঝে মনকে যে নাড়া দিতো না তা নয়।
কার্যোপলক্ষে অনেক পরিচিত-অপরিচিত মহিলাদের সাথে তাকে মিশতে হয়েছে। তাদের মাঝেই তিনি তার হারানো প্রিয়া বিলীন হয়ে আছে মনে করে সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করতেন। তারা সব আজ কোথায়! তার চাকুরি জীবন যেমন শেষ হয়ে গেছে, তেমন তাদের মধ্যে সিংহভাগেরও তো তাই হয়েছে।
কাজের সূত্রে বা অবসর সময়টুকু যাদের সাথে কাটিয়ে মনের পুঞ্জিভূত ব্যথা ভুলে থাকতে চেষ্টা করতেন তার মতো তারাও আজ কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, সে খবর জানা নেই।
তার জীবন সঙ্গিনী নেই তাই সংসারও নেই। যৌবনের প্রথম লগ্নটা স্বপ্নের মতো শুরু হয়েছিল। যেটা তিনি কোনো দিন কল্পনাও করেননি। পূর্বের জীবনে কিছুটা অবাধ্যতা ছিলো। বেপরোয়া জীবন তাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ভেসে যাওয়ার মধ্যেই হঠাৎ একদিন গভীর রাতে একটি ঘটনা তার জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিলো। আর সেটাই সত্য ও সুন্দর জীবনের হাতছানি মনে করে কঠিন হৃদয়কে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন পথে যাত্রা শুরু করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে আশাতিরিক্ত সাফল্য পেয়ে গেলেন। নিয়তি হয়তো তাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছে তাই হাসি আনন্দের মাঝে দুঃখ-বেদনা জুড়ে বসলো। একটি অসহনীয় শূন্যতা তাকে গ্রাস করলো। তিনি ধৈর্য হারাননি। তবু আকাশ ছোঁয়া সফলতার মাঝে থেকেও সেই শূন্যতাকে আজও পূরণ করতে পারেননি।
বিদায় বেলায় সহকর্মী বন্ধুদের উষ্ণ সংবর্ধনা তাকে আনন্দ দিতে পারেনি, দু’চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বেরিয়ে এসেছিলেন। যে বাড়িতে তিনি বর্তমানে আছেন সেটা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। সরকারি বাড়ি, মানে জনগণের সম্পদ। আর এক মুহূর্তও সেই বাড়ি আঁকড়ে থাকবার অধিকার নেই। তবু কোনো কারণবশতঃ তাকে সপ্তাহ খানেক থাকতে হচ্ছে।
কাজ ছেড়ে বাসায় এসে নিঃসঙ্গ জীবনের শূন্যতা তাকে পীড়া দিতো। তার থেকে মুক্তি পেতে অনেক দিন আগে গ্রাম থেকে দু’টি গরিব পরিবারের অল্প বয়স্ক ছেলে মেয়ে নিয়ে এসেছিলেন। শহরে এনে তাদের গড়ে নিয়েছিলেন। বাসার কাজ থেকে শুরু করে রান্না-বান্না, কেনা-কাটা পর্যন্ত তাদের দিয়ে সারতেন। তাদের একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার চিন্তা তিনি মাথায় নিয়েছিলেন। দু’জনকেই তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত নিজ তত্ত্বাবধানে পড়িয়েছেন। স্বাধীনভাবে কিছু করে খাওয়ার মতো যোগ্যতা পরিপূর্ণভাবে না হলেও আংশিকভাবে অর্জন করতে পেরেছে। এখন তাদের একটা ব্যবস্থা করে তিনি নিজের কথা পরে ভাববেন।
তিনি নিরাশ্রয়। দীর্ঘদিন উচ্চ পদে চাকুরি করে কোথাও মাথা গুঁজে থাকার মতো একটা ছোট্ট নীড়ও তিনি বাঁধেননি। গোটা দেশের মধ্যে কোথাও এক ইঞ্চি জমি তার নেই। পৈত্রিক সম্পদ পেয়েছিলেন পর্যাপ্ত পরিমাণ, অনেক আগে সব তার ভাই বোনদের মাঝে বণ্টন করে দিয়ে এসেছিলেন। যার কিছুই নেই তার চিন্তা চেতনার ধরনই আলাদা। নিজের সেজন্য কোনো ভাবনা নেই। যে গরিবের ছেলে মেয়ে দু’টি তিনি এনেছিলেন তারা আজ তারুণ্যের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছে।
আজ তাদেরকে এমনিই ছেড়ে দিলে বিবেক তাকে দংশন করবে এমন অনুভূতি তার আছে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর এশার নামায পড়ে শোবার আগে আলমগীর খান মুন্নি আর রিয়াজকে নিজের ঘরে ডাকলেন। শোবার খাটে তিনি পা ঝুলিয়ে বসে আছেন, তারা এলে বসতে বললেন। তারা বসতে সঙ্কোচবোধ করছিল। ইতোপূর্বে সাহেব কোনো দিন তার শোবার খাটে বসতে বলেননি। গল্প গুজব, হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ উল্লাস করেছেন সোফার ঘরে বসে। অনেক সময় খাবার টেবিলেও হতো। তাদের সম্পর্ক ছিলো দাদা নাতীর। তাই বড় সাহেবের বাসার চাকর চাকরানীর মতো শাসন শোষণ নির্যাতনের ছিটে ফোটার নামগন্ধও সেখানে ছিলো না। আপনের মতো সুসম্পর্ক গড়ে উঠলেও যা কিছু হতো খাওয়ার টেবিলে আর সোফার ঘরেই শেষ করতেন। ইতোপূর্বে কোনো দিন রাতে শোবার ঘরে ডাকেননি। দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি হাত ধরে দু’জনকে দু’পাশে বসিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে তাদের কাঁধে রেখে হাসিমুখে বললেন- আমার খেলা তো সাঙ্গ হয়ে গেলো এবার তোদের খেলাটা শুরু করি, কি বলিস?
দু’জনই চমকে উঠে সাহেবের মুখের দিকে আনত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সাহেবের মুখে প্রশান্ত হাসি। মুন্নি তার ডান হাতখানি দিয়ে সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বললো- আপনি হাসছেন কেন দাদু?
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে যেভাবে চেয়ে আছিস তাই দেখে হাসি পেলো। এবার বলতো দেখি আমি তোদের জন্য কি করতে পারি?
সেই কোন্ ছোটবেলায় আপনি আমাদের নিয়ে এসেছেন। সেই থেকে আপনার ইচ্ছার অনিচ্ছার প্রতি আমরা সম্মান দেখিয়ে এসেছি। আজ উল্টো কথা কেন দাদু?
এতোদিন আমার শাসন করবার ক্ষমতা ছিলো তাই প্রভাব খাটিয়েছি।
সেই ক্ষমতা কে কেড়ে নিলো দাদু?
আমার চাকুরি জীবন শেষ, অবসর নিয়েছি।
আপনি সরকারি চাকুরি করতেন তাই একটা নিয়মের মধ্যে অবসর নিতে হয়েছে এটাতো নতুন কিছু নয়। তাই বলে আমাদের উপর প্রভাব খাটানো শেষ হয়ে গেছে একথা বলছেন কেন?
ঘর বাড়িতে বাস করতাম বলে তোদের প্রয়োজন ছিলো। এবার পথে নামছি তোদের রাখবো কোথায়?
আপনার মতো মহৎ মানুষ আর দেশে আছে কিনা জানিনা। নিজের পৈত্রিক সম্পদ ভাই বোনদের দিয়ে এসেছেন। গ্রামের গরিব মানুষগুলোর নিজ পায়ে দাঁড়াবার মতো সংস্থান করে দিয়েছেন। আজ আপনার অসহায়ত্বের কথা ভেবে যদি আমাদের কোনো উটকো বোঝা মনে করেন তাহলে এখনই গলা টিপে মেরে ফেলুন দাদু!
কি সর্বনাশ! শেষ পর্যন্ত আমাকে শ্বশুর বাড়ি বাস করার পথ দেখালি?
আপনি তো শ্বশুর বাড়ি চিনলেন না তাই চেনাবার ব্যবস্থা করছি।
তোদের এতো আদর স্নেহ দিয়ে গড়ে তুললাম, লেখা পড়া শিখিয়ে চোখ ফোটালাম- সেটা যে বিফলে যাবে মুন্নি?
কেন?
আমি যদি শ্রী ঘরে যাই তাহলে অশান্তি আমাকে পীড়ন করবে না?
আপনার জীবনে অশান্তি নেমে আসবার আগেই আমার মৃত্যু হোক।
আমিও তোর মৃত্যু চাই, আর সেটা এই অপূর্ব পৃথিবী থেকে চির বিদায় নয়। বর্তমান জীবনের মৃত্যু ঘটিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করিয়ে দিতে চাই। তুই কি বলতে চাস?
এতো সুন্দর কোমল হৃদয় আপনার, সেখান থেকে এমন নিষ্ঠুর বাক্য কি করে বেরিয়ে এলো দাদু?
আমার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক কিছু নয়। জীবনকে সার্থক ও সুন্দররূপে প্রস্ফুটিত করবার মাধ্যম।
আপনার এই যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তটি তো সবার জন্য প্রযোজ্য তাই না দাদু?
তাই।
তবে আপনি সেই পথ থেকে শতহাত দূরে কেন?
তোদের নিয়ে দীর্ঘদিন সংসার করে এলাম, এটাতো অস্বীকার করা যাবে না।
সেটা কৃত্রিম।
এই যে দুই ডানায় জড়িয়ে রেখেছি- এর কি কোনো মূল্য নেই?
অপরিসীম মূল্য এর। আদর স্নেহ এর মধ্যে জড়ানো, বড় জোর ভালোবাসায় মোড়া, কিন্তু প্রেমের শাশ্বতরূপ এর মধ্যে নেই। সেখানে যার একচেটিয়া অধিকার, তিনি কোথায়? তাকে কেন বঞ্চিত করলেন দাদু?
আলমগীর খান উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন। বললেন আমি বঞ্চিত করবো কি, সুন্দরীরাই আমাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে খেদিয়ে দিয়েছে।
আজ একটা আজব কথা শোনালেন। আপনার মতো একজন যোগ্য ব্যক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর দুঃসাহস কোনো সুন্দরীর থাকতে পারে সেটা অবিশ্বাস্য।
কাজ করেছি, আর কেবল বেতনই নিয়েছি, একটি বাড়তি পয়সার দিকে হাত বাড়াইনি। সুন্দরীদের খেয়াল সেই লম্বা হাতের দিকে। খাটো হাত তাদের বহর মেপে পাবে কি করে?
আপনি এখন নিরাশ্রয়, বয়সও যৌবন পেরুতে গেলো। এমতাবস্থায় ইঙ্গিত দিয়ে দেখুন কত স্ন্দুরী ছুটে এসে পায়ের উপর মাথা কুটবে।
সুন্দরীদের একজন হয়ে তাদের অঙ্গে কালি লেপন কেউ সহ্য করবে না কিন্তু!
যিনি অসহ্য হয়ে ছুটে আসবেন তার দৃষ্টিতে আপনি পড়ে গেলে তিনি আমাকে নমস্কার করে বুড়োর ঐ চওড়া বুকে নেতিয়ে পড়বেন।
মুন্নির কথা শেষ হতেই রিয়াজ খুব জোরে হেসে উঠে বললো- দেখলেন দাদু! আসামী ধরা পড়ে গিয়েছে।
মুন্নি ধমক দিয়ে বললো- ধ্যাৎ! আসামী বলছো কাকে? দেখছো না, একেবারে গলা জড়িয়ে ধরে নেতিয়ে পড়েছি?
তাহলে আর দেরি করা কেন! মৌলভী বিদ্যে তো শিখে নিয়েছি, এখনই পড়িয়ে দিই?
আরে বোকার অপগম্ভ! আমি কি বিয়ে করার জন্য নেতিয়ে পড়েছি? দাদুর বুকে উষ্ণ স্পর্শ দ্বারা শিহরণ জাগিয়ে দিয়েছি। দাদু এবার বউ খুঁজে বেড়াক।
এবার রিয়াজের হাসি আর থামেনা। সেই সাথে আলমগীর খানও অট্টহাস্য করে উঠলেন।
মুন্নির কথা মেনে নিলাম। সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তার আগে মুন্নি রিয়াজ জুটি বাঁধার কাজ শেষ করে নিই, কি বলিস তোরা?
মুন্নি মুখ ভার করে বললো- ইস্! আমার বয়ে গেছে বলতে। দাদার পাশে দাদীর চেহারাটা না দেখা পর্যন্ত আমিও মুখ ফিরিয়ে থাকবো।
তাহলে তো আমার আর বউ খোঁজা হয় না।
কেন?
তোদের প্রতি আমার যে দায়িত্ব আছে তা যদি শেষ করতে না পারি তাহলে মনের দিক থেকে হালকা হতে পারছি না। অতএব নিশ্চিন্তে হারানো সম্পদ খুঁজে বের করা কোনো দিন সম্ভব হবে না।
আচ্ছা দাদু! একটি কথা জিজ্ঞেস করবো?
কর।
সত্যি করে বলুন দেখি, আপনি কি কোনো দিন বিয়ে করেছিলেন?
তোর কি মনে হয়?
ঐযে আপনি বললেন হারানো সম্পদ?
মিথ্যে বলিনি।
বিয়ে করে বউ হারিয়ে যাওয়া- এযে বড় তাজ্জব ব্যাপার মনে হয়। আপনার জীবনে করুণ কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে তা কি ব্যক্ত করা যায় না দাদু?
সে তো গোপন কিছু নয় কিন্তু পেছনের ঘটনা টেনে নিয়ে এসে অহেতুক কষ্ট পাওয়া কেন?
আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া ট্রাজেডী বর্ণনা করা পীড়াদায়ক হলেও প্রকাশ পেলে মনের কোণে জমাটবাঁধা পুঞ্জিভূত ব্যথার অনেকটা উপশম হবে তাতে সন্দেহ নেই। বলুন দাদু! আমরা শুনি। হয়তো আপনার কষ্টের বোঝা আমরাও কিছুটা মাথায় নিয়ে আপনাকে হালকা করতে পারবো।
মানব জীবনের এমন কিছু বিষয় আছে যা নিজে নিজেই বহন করতে হয়, অপরের বহন করার সুযোগ নেই। আমার পেছনের অর্ধেক জীবন তেমনই।
এমন কতক গল্প উপন্যাস আছে যা পড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। আবার কতক ছায়া ছবি দেখে দর্শকরা কাঁদতে কাঁদতে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসে। যদিও তা কাল্পনিক কাহিনী হোক না কেন, তাই বলে তেমন ছায়া ছবি নির্মাণ বন্ধ হয়ে আছে দাদু?
একদিন ছিলো চোখে আগুন, তাতে পুড়িয়েছি অনেককে। সেই আগুন যে নেভালো তার মূল্য আজ আমার কাছে অপরিসীম। সেদিন হয়তো এতো গুরুত্ব দেইনি। আগুনের শিখা যেখান থেকে ছিটকে বেরুতো পরবর্তীতে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো জলের ধারা। তাও একদিন নিঃশেষ হয়ে গেলো। তারপর আপন ইচ্ছায় তৈরি হলো যে হৃদয়, তারই ফসল তোরা দু’টি কপোত কপোতি।
আজ আমাকে দেখে কে বলবে নিভৃত পল্লীর তালপাতায় ছাওয়া কুঁড়ে ঘরের ঘুটে কুড়োনী মেয়ে। যে মহীয়সী নারী আপনার হৃদয় সোনা দিয়ে গড়ে গেছে শত কোটি সালাম জানাই তাকে। মনে হয় আপনার জীবনে সফলতা এসেছে সেখান থেকে। আপনার প্রথম জীবনের ইতিবৃত্ত কি জানতে পারবো না দাদু?
সে ছিলো আঁকাবাকা পথ তাই তার দৈর্ঘ্য মাপ-জোপের বাইরে। সময়ের হিসাব নিয়ে সে পথে নেমে পড়লে শেষ তো হবেই না বরং মনের খুতখুতানি বেড়ে যাবে।
এইচ.এস.সি. পাশ করে বেরিয়ে এলাম পড়াশোনার তাগিদ নেই, আপনিও অবসর নিয়েছেন। অফুরন্ত সময় আমাদের সামনে। অতএব সময়ের হিসাব কষতে যাবো কেন দাদু?
রাত গভীর হয়ে গেলো ঘুমাবে না?
আপনার জীবনের কিছু কাহিনী শুনতে আমাদের দুর্নিবার আগ্রহ, সেখানে দু’এক রাত না ঘুমালে এমন ক্ষতির আশংকা দেখি না, যদি আপনি কষ্ট না পান।
কষ্টকে আমি জয় করে নিয়েছি অনেক আগে, তাই তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কত রজনী যে কেবল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পার করেছি তার হিসাব নেই। তাতে আমার আত্মার উন্নতি হয়েছে, চলার পথকে করেছে প্রশস্ত। তোরা আমার কাছে আপনের চেয়েও আপন। তোরাই আমার নাতি পুতী। তোদের মনের জিজ্ঞাসার খোরাক যদি আমি না যোগাই তাহলে আজই হয়তো একটি সূক্ষ্ম পর্দা পড়ে যাবে। একদিন তা কঠিন প্রাচীরের রূপ নিতেও পারে। আমি তেমন নির্দয় দাদু হতে পারি না। চলো সোফার উপর যেয়ে আরাম করে বসি। সবাই উঠে পড়লো। প্রাকৃতিক প্রয়োজন মিটিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে নিজেকে সতেজ করে নিয়ে সোফার ঘরে যেয়ে সবাই বসে পড়লো।
দুই
আমি পিতা মাতার প্রথম সন্তান। দাদা দাদী, নানা নানী, তখন বহাল তবিয়তে। আমার পাওনার চেয়ে আদর স্নেহ ভালোবাসা অতিরিক্ত পেতাম। তাই শৈশব থেকেই মূল্য অত্যধিক। প্রতিবেশীরা এতোটুকু সময় কোলে নেয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করতো। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা আমাকে দেখার জন্য প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো। আবার নানা নানী, মামা মামীর খায়েশ মিটাতে আমাকে নিয়ে মায়ের ঘন ঘন বাপের বাড়ি যেতে হতো। কিন্তু তিনি সেখানে সপ্তাহও কাটাতে পারতেন না। দাদা দাদীর অভিমান ভাঙতে বাড়ি ফিরে আসতেন। এমনই শৈশব পেরিয়ে কৈশর এলো। দাদা স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এলেন। প্রতিবেশী ছেলেদের সাথে স্কুলে যেতাম। তখন পল্লী অঞ্চলের মেয়েদের স্কুলে দিতে চাইতো না। যদিও একটু পড়তে পাঠাতো তা মক্তব পর্যন্ত। দু’একজন যদিও স্কুলে নিজেদের মেয়েদের ভর্তি করাতো। কিন্তু তারা নিয়মিত যাতায়াত করতো না। কোনো শাসন না থাকায় আমি শৈশব থেকেই ছিলাম ডানপিঠে। তাই পাড়ার এমনকি স্কুলের আমার বয়সী ছেলে মেয়েরা আমাকে যমের মতো ভয় করতো। আমি তাদের উপর কর্তৃত্ব করতাম। হয় কাজ নয় করে প্রায়ই সোরগোল তুলে দিতাম। তাতে আমার যে শাস্তি হওয়ার কথা তা হতো না। তিরস্কারের পর উপদেশটাই বেশি করে পেতাম। কারণ শৈশব থেকে আমার মেধা ছিলো অত্যন্ত প্রখর। ক্লাশের প্রথম পদটি কেউ কোনো দিন দখলে নিতে পারেনি। তাই শিক্ষকরা আমাকে ভালোবাসতেন, উপদেশ দিতেন। কিন্তু আমার উশৃঙ্খলতা দূর করতে পারতেন না। আমার দাদা ছিলেন স্কুলের সভাপতি। তিনি সম্মানী লোক বিধায় আমার অত্যাচার সবাই নীরবে হজম করে যেতেন।
তখনকার দিনে যেখানে সেখানে বাজার ঘাট ছিলো না। সুবিধাজনক স্থানে হাটবাজার ছিলো। ঝিকরগাছা তেমনই একটা বাজার। কপোতাক্ষ নদের তীরে বিধায় ব্যবসা বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ ছিলো। উত্তর-দক্ষিণে নদী পথ, পূর্বে পশ্চিমে সড়ক পথ ঐ বাজারের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাজার থেকে মাইল খানেক দূরে বাগবাগিচায় ঘেরা এক মনোরম জায়গায় আমাদের বাড়ি। ঐ এলাকায় আমাদের পরিবারটি খান্দানীদের মধ্যে সেরা ছিলো। দাদা ছিলেন অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক, তারপর আবার ঝিকরগাছা বাজারে মস্তবড় ব্যবসা। তিনি অত্যন্ত সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে ছোট বড় সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। তার তিন ছেলে দুই মেয়ে। আমার বাবা ছিলেন সবার বড়। বাপ চাচারা লেখাপড়া শিখে দাদার ব্যবসার হাল ধরলে তিনি অবসর নেন। সে সময় আমার জন্ম। ঐ পরিবারে তখন আমার কেমন কদর ছিলো তা সহজেই অনুমেয়।
আমি তখন ক্লাশ নাইনে পড়ি। পূজার বন্ধের পর স্কুলে যাচ্ছি, দেখি পাকা রাস্তার ধারে বিরাট শিশু গাছের নিচে একটি দোচালা কুঁড়ে ঘর। তালপাতায় ছাওয়া, গাছের ডাল পাতা দিয়ে ঝাঁপ বেঁধে বেড়া দেয়া। রাস্তার দিকে কলাগাছের শুকনা পাতা দিয়ে ঘিরে আড়াল করা। রাস্তা থেকে ভিতরের দিকে যাওয়ার মুখে একটি ছেড়া চট ঝুলানো। তার ফাঁক দিয়ে একটি মেয়েকে আমার দিকে চেয়ে থাকতে দেখলাম। আমি তখনই সাইকেল থেকে নেমে নিকটে যেয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটি নড়লো না, তখনও সে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোথা থেকে এলে খুকি? সে বললো- দক্ষিণ থেকে।
কেন?
সেখানে সব সময় কাজ হয় না, দু’বেলা খেতে পারতাম না। এদেশে নাকি খুব কাজ পাওয়া যায়, তাই বাবা আমাদের নিয়ে চলে এসেছে।
এখানে কতদিন এসেছো?
আট দশ দিন হবে।
তোমার কে কে আছেন?
মা, বাবা আর একটি ছোট ভাই।
তারা কোথায়?
বাবা ঝিকরগাছা বাজারে ভ্যানগাড়িতে মাল টানে। মা পরের বাড়ি কাজ করতে গেছে।
তুমি কি করো?
কিছু করিনে।
দক্ষিণে থাকতে কি করতে?
মাছ ধরতাম আর পাতা কুড়াতাম।
স্কুলে যেতে না?
আমরা গরিব মানুষ, খাওয়া হয় না, জামাকাপড় জোটে না, স্কুলে যাবো কি করে। লেখাপড়া বড় লোকের জন্যে।
কথা বলতে বলতে মেয়েটি ছেড়া চট ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। একেবারে আমার সামনা সামনি। তার পরনে শতছিন্ন তালি দেয়া ময়লা একটি শাড়ী কি থান কাপড় তা বুঝতে পারলাম না, ওর সারা অঙ্গ জড়ানো। মেয়েটির উজ্জ্বল চেহারা মলিনতায় ছেয়ে আছে। মনে হলো ক্ষুধায় কাতর এক বোবা আত্মা তাকে ঠেলে বের করে আমার সামনে নিয়ে এসে বলছে এরাও মানুষ। আমার মতো একটা ডান পিঠে ছেলের অন্তরও সেই মুহূর্তে করুণায় ভরে গেলো। স্কুলের বেতন আর একখানা খাতা কিনবো বলে মায়ের কাছ থেকে দশ টাকার একটি নোট নিয়ে এসেছিলাম। পকেট থেকে নোটটি বের করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম- এটা নাও তোমাদের অনেক কাজে লাগবে। সে এবার লজ্জা পেয়ে গেলো, কিছুতেই টাকা নেবে না। চট্ ঠেলে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকলো। ক্ষুধায় কাতর অভাবী মেয়েটির এমন আত্মমর্যাদাবোধ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। পরমুহূর্তে আমার উগ্র স্বভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। জেদ চেপে গেলো মেয়েটিকে টাকা নিতে বাধ্য করবো। সাইকেল শিশু গাছে হেলান দিয়ে ভেতরে যেয়ে দেখি ঝাপ দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ পথ আটকানো। আমি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলাম। জোর করে ঝাপ ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। মেয়েটি এক কোণে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। আমি কোনো কথা না বলে জোর করে তার মুঠোর মধ্যে নোটটি গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে এসে সাইকেল চেপে স্কুলে চলে গেলাম।