ডায়ারির পাতা থেকে
()
About this ebook
পুরানো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ডায়ারির কিছু ছেঁড়া পাতা পেয়ে গেলাম। অনেক অতীত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই পাতাগুলোতে
Ratan Lal Basu
ADDRESS: KOLKATAPh. D. in EconomicsProfession: Retired from 1st January, 2009 from the post of Reader in Economics and Teacher-in-Charge, Bhairab Ganguly College, Kolkata, India
Read more from Ratan Lal Basu
অসাধারণ-সুন্দর ও অন্যান্য গল্প Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsস্বপ্নের সন্ধানে Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsগণেশ ঠাকুরের ভক্ত ও অন্যান্য গল্প Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsগল্পের ফুলঝুরি Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsদূরের পাহাড় ও অন্যান্য গল্প Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsপ্রতিবিম্ব Rating: 0 out of 5 stars0 ratings
Related to ডায়ারির পাতা থেকে
Reviews for ডায়ারির পাতা থেকে
0 ratings0 reviews
Book preview
ডায়ারির পাতা থেকে - Ratan Lal Basu
ডায়ারির পাতা থেকে
Ratan Lal Basu
Copyright 2022 Ratan Lal Basu
Smashwords Edition
Smashwords Edition, License Notes
Thank you for downloading this free ebook. Although this is a free book, it remains the copyrighted property of the author, and may not be reproduced, copied and distributed for commercial or non- commercial purposes. If you have enjoyed this book, please encourage your friends to download their own copy at Smashwords.com, where they can also discover other works by this author. Thank you for your support.
CONTENT
মাতৃহীন
কান্তির কেরামতি
বর্ধমানের কনফারেন্স
যখন সময় থমকে দাঁড়ায়
কলকাতায়
ঝড় বৃষ্টি মেঘের খেলা
বেলাকোবার নিস্তব্ধতায়
লেখক পরিচিতি
মাতৃহীন
১৯শে জুন ১৯৬৫
ব্যায়াম করছিলাম বিকালে। কিছুটা ওয়েট লিফটিং ও করলাম। আসন করছি এমন সময় মাণিক বলল একটা কাঁচা আম আনতে। সরোজকে খাওয়াবে। সরোজের ভাং খেয়ে খুব নেশা ধরেছে। যাই হোক ভেতরে গিয়ে চুপিচুপি ঘরের পিছন দিয়ে একটা কাঁচা ভূতোবোম্বাই আম এনে দিলাম। সন্ধেবেলা স্নানাদি সেরে চিঠি পোস্ট করতে বের হব, এমন সময় মাণিক বলল সরোজকে সাইকেলে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। রাজি হলাম। প্যান্টের পা গুটিয়ে সাইকেলে চড়লাম। সরোজের শরীর টলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সরোজের কথামত R. R. স্কুলের কাছে কালীমন্দিরের কাছে নামলাম। মন্দিরে গিয়ে সরোজ বলল, ‘মা, ভালো করে দাও’।
আমি বললাম, ‘এবার চল’। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে এনেছ। এখন কি যাব? এত তাড়াতাড়ি গেলে ধরা পড়ে যাব’। আমি ঘাবড়িয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ওকে সাইকেলে চড়িয়ে নিলাম। এবার নামলাম রাধেশ্যামের বাড়ির সামনের বট গাছটার কাছে। রাধেশ্যাম ওখানদিয়ে গেল। আমার যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে কথাটা ঘুরিয়ে দিলাম। এবার সরোজকে বমি করতে বললাম। ও অনেক কষ্টে কিছুটা বমি করল। বলল একটু আরাম বোধ করছে। এবার ওর মুখ ধোওয়ার জন্য জলের দরকার। দিলীপদের বাড়ির সামনের কুয়োর পাড়ে দেখি বালতি নেই। ‘দিলীপ’ বলে ডাকতেই ওর মা বললেন, ‘কে?’। আমি বালতি চেতেই বালতি দিলেন। আমি মিথ্যা করে বললাম সরোজ কাদায় পড়ে গেছে। জল তুলে সরোজকে দিলাম। দিলীপের ভাই আলো আনছিল। সরোজ বারণ করল। মুখ ধুয়ে নেওয়ার পর সাইকেল হাতে ধরে আমরা হেঁটে রওনা হলাম। সরোজ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় করতে লাগল।
ওদের বাড়ি পৌঁছলাম। সরোজ ঘরে গেল। ওর বাবার ঘর থেকে আলো নিয়ে এলাম। ওর বাবা তখন আসন করছিলেন। ওর ঠাকুমা শুয়েছিলেন বিছানায়। কেউ প্রশ্ন করলনা কেন সরোজের দেরি হল। আমি শুধু বললাম, ‘সরোজ ব্যায়াম করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে’। কেউ শুনল কিনা জানিনা। সরোজের বোন জল এনে দিল। আমি বিছানা করে দিলাম। সরোজ হাতপা ধুয়ে শুয়ে পড়ল। আমি বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। সরোজের বাড়িটা কেমন ভৌতিক মনে হল। বাড়ির সকলে যেন মৃত পুতুল। আশ্চর্য কেউ ওর খোঁজ করলনা। ওর অসুস্থতার জন্য কেউ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলনা। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আমার মন বিষ্ময়ে পরিপূর্ণ হচ্ছিল। সরোজের বাড়ির পরিবেশটা এই নিশ্ছিদ্র ঘন অন্ধকারের চেয়েও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। দূর থেকে একটা সাইকেল আসছিল। হঠৎ সাইকেলের লাইটের তীব্র আলো লেগে আমার চোখটা জ্বালা করে উঠল। মনে পড়ল সরোজেরতো মা নেই। মারা গেছেন এক বছর আগে।
একটা সুন্দর ট্রেন যাত্রা
২৮শে জুন, ১৯৬৫, সকাল ১০টা
দীর্ঘ দুমাস কেটে গেল। ফুরিয়ে এল গ্রীষ্মের বন্ধ। সুন্দর কেটে গেল ঘরের কোণে বসে, গ্রাম্য নিরালায়। অবশ্য আমাশয় ও পড়ে গিয়ে হাত কেটে গিয়ে কিছুটা শারীরিক কষ্ট পেয়েছি। যাইহোক বুঝতেই পারছিনে যে আজ আমাকে চলে যেতে হবে। কাল সারারাত ধরে ছুটির কাজকর্মের হিসাব-নিকাশ করলাম। পরিকল্পিত কাজের অনেকটা শেষ করতে পেরেছি আবার করতে পারিনিও অনেকটা। আবার মনের মাঝে রয়েছে কলেজ পরীক্ষার রেজাল্টের অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তা। সন্তোষকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ও এরমধ্যে আসবে। আর ওকে দিয়ে থ্রুকোচে একটা বার্থ ম্যানেজ করা যাবে। যাই হোক সন্তোষ আসেনি এরমধ্যে। হয়তো এগারোটার গাড়িতে আসবে আমাকে See off করার জন্য।
বিকাল ৪টে
৬ঘণ্টা কেটে গেল। ইতিমধ্যে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছি। ভবানীদার সাথে আলাপ করছিলাম দেশের পরিস্থিতি আর রাজনীতি সম্বন্ধে। হঠাৎ সন্তোষ এসে পড়ল। সন্তোষের সঙ্গে Communism ও অন্যান্য কিছু বিষয় সম্বন্ধে সামান্য আলোচনার পর স্নান করতে গেলাম। সন্তোষ এগারোটার গাড়িতে এসেছে। স্নান খাওয়া সেরে সন্তোষের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর মাণিকের বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। সন্তোষকে পড়তে দিলাম ‘প্রবাসী’। দীর্ঘক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকেও ঘুম হল সামান্যই। নানান চিন্তায় মনটা ভরেছিল। বিছানা থেকে উঠে চোখমুখ ধুয়ে নিলাম। সন্তোষের প্রস্তাবমতো এবার বেড়াতে বের হব। সকাল নটার গাড়িতে ভবানীদারা এসেছেন।
সন্ধ্যা সাতটা
খাওয়াদাওয়া সেরে রেডি হয়ে নিয়েছি। এবার বের হওয়ার পালা। বাইরে প্রবল আর সন্তোষ অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ আগেই সন্তোষের সাথে বেড়িয়ে এসেছি। বাড়ি থেকে বেরোতে প্রথমেই দেখা হল মধূ-র সম্বন্ধীর সঙ্গে। ওর নাম বিজয় চৌধুরি। ওর নামটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর সাথে প্রথমে দুপুর বেলা দেখা হয়। ও আর একটা ঠাকুরগঞ্জের ছেলে আমার আর সন্তোষের সাথে চলল। আমরা চললাম বাবুপাড়ার দিকে। রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের কাছে যেতেই এল বৃষ্টি। মন্দিরে অপেক্ষা করলাম। বৃষ্টি থামলে আবার রওনা হলাম। বিজয়ের বন্ধুর নাম চুনি। বাবুপাড়ার কাছে পৌঁছলে সন্তোষ গোবিন্দর বাড়ি গেল। ইতিমধ্যে নির্মল বসাকের সঙ্গে চিত্তরঞ্জন বসাক এল। চিত্তরঞ্জনের সাথে কিছুদিন আগে পরিচয় হয়। ও নির্মলের জ্যাঠতুতো ভাই। ওরা আগে এখানে থাকত। ও নাকি বেসিক স্কুলে ক্লাশ ফোর এ পড়েছে। ও এখন জলপাইগুড়িতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং Second Year এ পড়ছে। হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছিল কুচবিহার থেকে। ও নম্বর পেয়েছিল মোট ৬০৫। ওদের স্কুল থেকে আরও একজন সাইন্সে ৬৬৭ নম্বর পেয়েছিল। সেও জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে। ইতিমধ্যে জীবন এল। ওর কাছ থেকে আমার প্রয়োজনীয় কাগজটা নিলাম আর কিছুটা খবর নিলাম গৌরাঙ্গ সম্বন্ধে। সন্তোষ ফিরে আসার পর বেড়ালাম চিত্তরঞ্জনের (ঘটু) সঙ্গে। আলাপ হল বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে। ন্যাশন্যাল লোন স্কলারশিপ সম্বন্ধেও আলোচনা হল। রেজাল্ট সম্বন্ধে অনেক কথা হল। ওকে বিদায় দিয়ে পান খেয়ে সন্তোষের সাথে বাড়ি এলাম। এরপর ভবানীদার টাকা ভাঙাতে গেলাম।
৯টা-৩০ (নিউ জলপাইগুড়ি)
বাড়ি থেকে সবকিছু গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাবা-মা উপদেশাদি দিলেন। বড়দের প্রণাম করে বের হলাম। বুড্ডু ভাত খাচ্ছিল। আমার সাথে স্টেশনে চলল মাণিক, রিন্টুনেলু, গোপাল (হদবদ), প্রবল ও সন্তোষ। সন্তোষ প্রথমে ৬-৩০ এর গাড়িতে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু থেকে গেল আমাকে See off করার জন্য। মা, রানু ও বৌদি গেট পর্য্যন্ত এলেন। আমার কাছে মাল মোট পাঁচটা। স্টেশনে যেতেই যমুনার সাথে দেখা হল। শুনলাম বিজনদা ও তপনদা যাচ্ছেন। কথায় কথায় বিজনদার খারাপ ব্যবহারের সমালোচনা হল। আমি চলে যাচ্ছি বলে মাণিকের মন খুব খারাপ হয়েছে দেখলাম। মাণিক সন্তোষকে বলল, ‘সন্তোষ, আজ রাতে তুই আমার কাছে থাকবি, আমার মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে’। আমার মনে কিন্তু বিশেষ কোনো কষ্ট হচ্ছেনা। আমার মনটা কেমন যেন অনুভূতিশূণ্য হয়ে পড়েছে। ট্রেন আসতেই থ্রু কম্পার্টমেন্টে চড়লাম। দেখলাম কোনো সিটই খালি নেই। ইতিমধ্যে বড়দা এলেন। বড়দাকে প্রণাম করলাম। নেলু-রিন্টুকে আদর করলাম। গাড়ি ছাড়লো। ‘বাই বাই’ বলে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। গাড়িতে দেখলাম জায়গা পাবার কোনোই সম্ভাবনা নেই। ভাবলাম নিউজলপাইগুড়ি গিয়ে অন্য কম্পার্টমেন্টে চড়ব। গাড়ি চলল দ্রুত গতিতে, আমাকে বেলাকোবা থেকে দূরে নিয়ে।
ইতিমধ্যে চেকার উঠল। আমার বইএর বস্তাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এটা কার?’
আমি বললাম, ‘আমার’। ‘কি আছে?’ ‘বই আছে’, গম্ভীরভাবে বললাম আমি। তারপর চেকারকে টিকিট দেখালাম। গাড়ি অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। দূর থেকে নিউজলপাইগুড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। রেডি হয়ে নিলাম নামার জন্য। ভাবলাম অন্য গাড়িতে জায়গা করে নেব। মালগুলো দরজার কাছে টেনে নিয়ে এলাম। হঠাৎ এক ভদ্রলোক বললেন যে একটা জায়গা আছে। তাড়াহুড়ো করে মালগুলো ভিতরে নিয়ে এলাম। সিটটার কাছে যেতেই যে বসেছিল সে বলল, ‘কে বসবে তা আমি জানিনা। পারেনতো বসেন’। পূর্বের ভদ্রলোক আমাকেই বসতে বললেন। আমার মনে তখন উদবেগ, সিট পাই কি না পাই। ভদ্রলোককে বললাম, ‘Thank You’। যাই হোক গাড়ি এসে থেমেছে নিউজলপাইগুড়িতে। আমার সিটটা জানলার ধারের সিঙ্গল সিট। পাশের বড় সিটে দুটো কিশোরী বসে আছে। কথা থেকে মনে হচ্ছিল দুই বোন।
মঙ্গলবার সকাল
নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে গাড়ি থামতেই আমার পোঁটলা খুলে হাওয়ার্ড ফাস্ট এর ‘নগ্ন দেবতা’ বইটা পড়তে শুরু করলাম। কমিউনিজমের বিভৎসতা বর্ণনাই বইটার মুখ্য বিষয়। গম্ভীরভাবে বইটা পড়ে চলেছি এমন সময় বড় মেয়েটা আমার জানলার কাছে এল। হঠাৎ আমি ব্যস্তভাবে ওর স্পর্শ বাঁচাতে যাওয়ায় ফিক করে হেসে ফেলল মেয়েটা। এরপর ওরা দুইবোনে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করল। অবশ্য আমার গাম্ভীর্যকে লক্ষ্য করে কিনা বলতে পারিনে; কারণ আমি তখন বইএর পাতায় মগ্ন। এরপর দেখলাম কতগুলো ছেলেকে মেয়েদুটোর সাথে কথা বলতে। যাইহোক এবার আমি গাম্ভীর্য পরিত্যাগ করে যাত্রীদের সাথে পরিচিত হতে চেষ্টা করলাম। আমার সামনে দুজন পশ্চিমা বসেছিল। বলল একজন বারসই যাচ্ছে ও অন্যজন কলকাতা যাচ্ছে। এবার আগের সেই ছেলেগুলো এল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা কোথায় যাবেন?’
‘আমরা সকলে নয়, ও যাবে’ বলে একজনের দিকে ইঙ্গিত করল। ছেলেটার চেহারা অনেকটা স্বরাজের মত আবার কিছুটা তপন দাসের মত। ছেলেটা বলল ও বেলুড় বিদ্যাপীঠ কলেজে পড়ে। ওরা গাড়ি থেকে নেমে স্টেশনে গেল। সামনে একজন পুলিশ কনস্টেবল বসেছিল। আমি ভাবলাম ঐ ভদ্রলোকই বুঝি মেয়েদুটোর বাবা। বড় মেয়েটাকে গিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’ ‘দমদম’ অত্যন্ত নিচু স্বরে বলল মেয়েটা। ‘ওখানে বাড়ি বুঝি?’ ‘না, বাবা কাজ করেন’। এবার পুলিশ কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ভদ্রলোক আগে জলপাইগুড়িতে থাকতেন। নতুন বদলি হয়েছেন কাঁচড়া পাড়ায়। ভদ্রলোকের সঙ্গে আর একজন অবাঙালি কনস্টেবল ছিল। সে রাইটার্স বিল্ডিংস এ কি কাজে যাচ্ছে। কনস্টেবল ভদ্রলোক আমার সরাসরি প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে এক মোটা অবাঙালি ভদ্রলোক এলেন। ওই মেয়েদুটোর শোয়ার জন্য ছেলেগুলো একটা বেঞ্চ ম্যানেজ করেছিল। ভদ্রলোক বসতে চেলে কনস্টেবল প্রতিবাদ করলেন। এরপর সেই ছেলেটা এল। মেয়েদুটোকে শোয়ার ব্যবস্থা করেদিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওরা আপনার রিলেটিভ নাকি?’ ‘না আমার এক বন্ধুর ভাগনি, বাড়ি দমদমে, কলকাতায় পড়ে, বন্ধে এখানে বেড়াতে এসেছিল, এখন বাড়ি ফিরছে’। ছেলেটার সাথে অনেকক্ষণ আলাপ করলাম। ও জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পাশ করেছে। এখন ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বেলুড় কলেজে বি. এ. পড়ছে। জলপাইগুড়ির বিভিন্ন ছেলে ও মেয়ে সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হল। এবার আলোচনা হল বেলুড় কলেজের বন্ডেজময় অসুস্থ পরিবেশ সম্বন্ধে। ও নাকি ফেড আপ হয়ে গেছে। ও কলেজের ফুটবল টিমে রাইট ইনএ এবং ক্লাশের ক্রিকেট টিমে খেলে। সত্যি বেলুড় কলেজের বন্ধনময় দুস্থ পরিবেশের বিভৎসতা সম্বন্ধে আমি মিথ্যা কল্পনা করিনি। আমি এবার জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিবিড় নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে আমার দৃষ্টি হারিয়ে গেল। এরপর করলাম ঘুমানোর চেষ্টা। কিন্তু বসে বসে ঘুম আসা অসম্ভব। নানান ভাবনা এসে জমা হল মাথায়। রাত গভীর হল। সারা গাড়ি নিঝুম।
‘সারারাত ঘুম হয়নি। বসে কি আর ঘুম হয়? সময় কেটে গেল। এসে গেল মালদা স্টেশন। ইতিমধ্যে আমাকে যে বসতে দিয়েছিল তারসাথে আলাপ হল। বাড়ি জলপাইগুড়ি। কলকাতা যাচ্ছে কার বিয়েতে। সঙ্গে আরো কে কে যেন যাচ্ছে। আসামের গোয়ালপাড়ার এক ভদ্রলোক আম কিনতে ছাতা নিয়ে নামলেন।
গাড়ি মালদহ স্টেশনে এসে থেমেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সারারাত্রির অনিদ্রাজনিত ক্লান্তি শরীরটাকে অবশ করে ফেলেছে।
ফারাক্কা স্টেশনে
মালদা থেকে গাড়ি ছাড়ল। বেলুড়ের ছেলেটা বলল, ‘রাত্রে ঘুম কেমন হল?’
বললাম, ‘একদম ঘুম হয়নি’। ‘তোমাকে মাঝখানেত ঘুমাতে দেখলাম’। ‘ও সামান্যই। তোমারতো বেশ ভালো ঘুম হল বাঙ্কে শুয়ে’। ‘না, কোথায়? একটু শুয়েই নেমে পড়েছি’। আমি বললাম, ‘আমি উপরে শুতে গিয়েছিলাম। দেখি তুমি শুয়ে আছ’। আবার ঘাট পারাপারের কথা উঠল। ও বলল জলপাইগুড়ির আর এক ভদ্রলোক আছেন এই কামরায়। তিনি যা করেন ও তাই করবে। আমরা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। এল চামাগ্রাম। বাইরের দৃশ্য বড় সুন্দর লাগছিল। আমি এবার ছেলেটাকে বললাম, ‘তোমার নাম কি? এতক্ষণ নামই জানা হলনা’। ‘চন্দন চক্রবর্তী। তোমার?’ ‘রতন লাল বসু’। শেষ কথাটা ও গাড়ির শব্দে ঠিক শুনতে পায়নি। তাই বলল, ‘রতন লাল কি?’ ‘বসু’। ‘বেশ ভালো কথা’।
ঠিক হল যে আমি আর চন্দন লঞ্চে করে আগে গিয়ে ওপারের গাড়িতে জায়গা রাখব। আর ঐ ভদ্রলোক মেয়াদুটোকে নিয়ে স্টিমারে করে পরে যাবেন। গাড়ি এসে পৌঁছল খেজুরিয়া ঘাট। ইতিমধ্যে একটা বিরক্তিকর কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি পেচ্ছাপখানার দরজা খোলা দেখে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে দেখি এক ভদ্রমহিলা। গাড়ি থামতেই আমি আর চন্দন লঞ্চের দিকে রওনা হলাম, সব মালপত্র হাতে নিয়ে। লঞ্চে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম ছোটকু (তপন রায়)কে দেখে। ও এখন দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজে পড়ছে। লঞ্চ থামতে চন্দন সামান্য জিনিস নিয়ে ছুটল জায়গা ম্যানেজ করতে। আমি কুলির মাথায় বাকি মাল দিয়ে পিছে পিছে চললাম।
চন্দন জায়গা পেলনা, কারণ প্যাসেঞ্জার গাড়ির যাত্রীদের নিয়ে আগে একটা লঞ্চ এসেছিল। যাইহোক চন্দন লেডিস কম্পার্টমেন্টে মেয়েদুটোর জন্য দুটো সিট পেয়ে গেল। সিটদুটো আগলে বসে থাকল।